ঢাকা, শুক্রবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বন্ধুদের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী 

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৩৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৪, ২০১৯
বন্ধুদের সঙ্গে উচ্ছ্বসিত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী 

ময়মনসিংহ: প্রায় ২০ বছর পর নিজের চিরচেনা সেই শিক্ষাঙ্গণে তিনি ফিরলেন। সেই ভবন, ক্লাসরুম, ক্যাম্পাস শ্যাডো এখনও যেন তার স্মৃতিতে অমলিন। বন্ধুত্বের বন্ধনকে তুলে ধরলেন বিশ্ব মানচিত্রে। আনন্দের ভেলায় নিজেকে ভাসিয়ে দিলেন। টুকরো টুকরো স্বর্ণালী স্মৃতি আওড়ে গেলেন। তখন চোখেমুখে ছিলো ভীষণ উচ্ছ্বাস। 

সোনালি দিনের স্মৃতি হাতড়ে বললেন নিজের ক্যাম্পাস জীবনের কঠোর পরিশ্রম, অসুস্থ হয়ে পড়া আবার সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা। চির অম্লান সেই স্মৃতি তাকে আপ্লুত করলো।

 

আনন্দ-অশ্রু ঝরালো তার সহপাঠীদের চোখেও। স্বপ্নিল শিক্ষা জীবন শেষে রাজনীতিতে প্রবেশ করলেন। নিজের অর্জিত জ্ঞান দিয়ে আত্মনিয়োগ করলেন দেশসেবায়।  

অলংকৃত করলেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। প্রায় দেড় যুগ পর বন্ধুত্বের টানে স্মৃতির ক্যাম্পাসে ফিরে এভাবেই অন্যরূপে ধরা দিলেন শান্তির দেশ খ্যাত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী ডা. লোটে শেরিং।  

ভুটানের এই প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের (মমেক) ২৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। ১৯৯১ সালে এখানে পড়তে আসেন এই রাজনীতিক। ১৯৯৯ সালে এমবিবিএস পাস করেন। রোববার (১৪ এপ্রিল) সকাল ১১টার দিকে নিজের শিক্ষাজীবনের পীঠস্থান মমেক ক্যাম্পাসে যান তিনি।  

বেলা ১২টার দিকে কলেজ অডিটরিয়ামে আয়োজিত বিশেষ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ডা. লোটে শেরিং শিক্ষার্থীদের পরামর্শ ছাড়াও নিজের শিক্ষা জীবনের নানা ঘটনা তুলে আনেন স্মৃতিপ্রকোষ্ঠে।  

চিকিৎসক হওয়ার আগে ভালো মানুষ হওয়া জরুরি এমন বার্তাও দিয়ে যান শিক্ষার্থীদের।

সোজাসাপ্টা কথা বলার মানুষ ডা. লোটে শেরিং। দুইদিন আগে ঢাকায় ব্যবসায়ীদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশি এক অধ্যাপকই তাকে শিখিয়েছেন কীভাবে খাঁটি, আন্তরিক হতে হয়, কীভাবে সোজাসাপ্টা কথা বলতে হয়।  

মমেক ক্যাম্পাসে স্মৃতিচারণ করেন  ডা. লোটে শেরিং।  ছবি:  ভুটান পিএমও এর সৌজন্যে ১৯৯৯ সালে ঢাকায় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিয়ে এফসিপিএস কোর্স সম্পন্ন করেন তিনি।

আলোচনায় শেখার অভ্যাস 
অনেক আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভরপুর যৌবনের স্মৃতির মমেক ক্যাম্পাসে ফিরে স্বর্ণালী স্মৃতি টেনে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি ১৯৯১ সালের নভেম্বরের দিকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে ভর্তি হই। তখন আমার বন্ধুরা ইতোমধ্যেই তাদের কোর্স শুরু করে দিয়েছে। আমি ৪ থেকে ৫ মাস বিলম্বে এসেছিলাম।  

‘তাই আমাকে কঠিনভাবে পড়াশুনা করতে হয়েছে। আমি ছাত্রাবস্থায় এনাটমি পড়ছিলাম। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি একটি চাপ্টার কয়েকবার রিভাইজ করার জন্য। এটা আমি কমপক্ষে তিনবার পড়তাম। ’ 

হোস্টেল জীবনের বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমি আমার বন্ধুদের রুমে নিয়ে গিয়ে যা শিখেছি ভালো হোক মন্দ হোক তা একবার পড়ে শুনাতাম। এরপর নিজে পড়তাম। এই প্রক্রিয়াতেই আমি একটি চাপ্টার তিনবার পড়ে ফেলতাম।

‘যখন আমার বন্ধুরা কষ্ট করে একবার পড়া শেষ করতো। এখান থেকে আমি একটা শিক্ষা নিয়েছি, আমরা যদি কিছু শিখতে চাই সেটা অল্পতে শিখতে পারবো না। আমাদের আলোচনার মধ্যে দিয়েই শিখতে হবে। ’ 

‘এর আগে আমি কখনও লেকচার দিইনি। তাই আমার লেকচার কিন্তু আপনারা অনুসরণ করবেন না’ বলেই হেসে উঠেন ডা. লোটে শেরিং।  

এ সময় গোটা হলরুমের দর্শকদের হাসির রোল পড়ে যায়।  

অসুস্থ হওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা 
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়া অবস্থাতেই অ্যাপেনডিসাইটিসের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন ডা. লোটে শেরিং। তখন তিনি হোস্টেলের ওয়েস্ট ব্লকের ২০ নম্বর কক্ষে থাকতেন।  

তৎকালীন আবাসিক চিকিৎসকের খামখেয়ালীপনার বিষয়টি শেরিং উপস্থাপন করেন উদাহরণ দিতে গিয়ে।  

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আরপির (আবাসিক চিকিৎসক) কাছে গেলে তিনি আমাকে ওমিপ্লাজল এবং ব্যাথানাশক ওষুধ দিয়ে দিলেন। ওইটা নিয়ে আমি আবার আমার ২০ নম্বর কক্ষে চলে গেলাম। বিশ্রাম নিলাম। যদিও ওমিপ্লাজল, রেনিটিডিন কোনো কিছুই কাজ করলো না।  

‘এরপরের দিন সকালবেলা আমি আবারো বন্ধুসহ একই আরপির কাছে গেলাম। তখন তিনি বললেন, যদি ক্লাস না করে বিশ্রাম নিতে চাও স্টুডেন্ট কেবিনে গিয়ে ভর্তি হও। আমি একটি স্টুডেন্ট কেবিনে ভর্তি হয়ে গেলাম। চিকিৎসকেরা আসছেন, যাচ্ছেন। ’

তিনি বলেন, এরপর সার্জারি ডাক্তারদের একটি টিম এলো। একজন বললেন, আরে এই ছেলেটা এভাবে পড়ে আছে কেন? কতদিন ধরে এভাবে আছে? এটা তো অ্যাপেনডিসাইটিস। দ্রুত অস্ত্রোপাচার দরকার। ওই চিকিৎসক আমাকে আশ্বস্ত করলেন।  

‘সেদিন রাতে সম্ভবত ৯টা থেকে ১০টায় অপারেশন হলো। আমি দুই থেকে তিন সপ্তাহ কেবিনে অবস্থান করলাম। এরপর সময়মতো ক্লাস শুরু করলাম। ’

এই প্রসঙ্গে ডা. লোটে শেরিং বলেন, ‘আসলে আমরা আমাদের কাজটা একটু হালকাভাবে নিলে আরেকজনের জীবনের মূল্য দিতে হতে পারে। সেজন্য অবশ্যই ব্যাপারগুলোকে সিরিয়াসলি নিতে হবে। সেজন্য প্রত্যেকটি রোগীর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া উচিৎ। ’

পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কারণেই প্রধানমন্ত্রী! 
লোটে শেরিং বলেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে আমি ও আমার সহপাঠী বর্তমান ভুটানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডা. টান্ডি দরজিসহ ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ওয়েস্ট ব্লকের ২০ নম্বর কক্ষে থেকেছি।  

‘এখনও একসঙ্গে আমরা রাজনীতি করছি। এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের মাঝে কোনো মনোমালিন্য হয়নি। আজকে তার কারণেই আমি প্রধানমন্ত্রী, তিনিই আমাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছেন। ’ 

যেভাবে বরণ করা হলো লোটে শেরিংকে 
সকালে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে করে ময়মনসিংহে পৌঁছেন ভুটানের প্রধানমন্ত্রী। কলেজ শিক্ষার্থীরা তাকে স্বাগত ও বন্ধুরা ফুলেল শুভেচ্ছা জানান।  

পরে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন তিনি। অনুষ্ঠানে তার ছাত্রজীবনের ৭৪ জন বন্ধু ছিলেন। বন্ধুদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন তাদের ডাকেই তিনি এসেছেন।  

ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ অধ্যক্ষ প্রফেসর ডা. আনোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান ও স্বাস্থ্য সচিব জি এম সালেহ উদ্দিন।  

এ সময় ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. টান্ডি দরজি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী লায়োনপু দিহেন ওয়াংমু, প্রধানমন্ত্রীর সহধর্মিণী ডা. উগেন ডেমা, জেলা প্রশাসক ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস, পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ আবিদ হোসেন, ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডা. লক্ষ্মী নারায়ণ মজুমদার, বিএমএ ময়মনসিংহ শাখার সভাপতি ডা. মতিউর রহমান ভূঁইয়া প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে কলেজের পক্ষ থেকে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে একটি ক্রেস্ট উপহার দেয়া হয়।  

বাংলাদেশ সময় ১৭০০ ঘন্টা, মার্চ ১৪, ২০১৯ 
এমএএএম/এমএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।