ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা শামীমের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৯
অধ্যক্ষ সিরাজের নির্দেশে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা শামীমের

ঢাকা: ফেনীর সোনাগাজীর ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যা করতে কারাগারে থেকে নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা। আর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেন শাহাদাত হোসেন শামীম।

পুলিশ বলছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী বোরকা পরিহিত চারজন ভবনের ছাদে হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। এর মধ্যে কমপক্ষে একজন মেয়ে ছিল।

আর পুরো হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় এখন পর্যন্ত দু’জন মেয়েসহ ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

শনিবার (১৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই-এর প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, গত ৪ এপ্রিল গ্রেফতার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলাকে মুক্তির দাবিতে নূর উদ্দিন, শামীমসহ অন্যরা মানববন্ধন করে। এরপর তারা বিভিন্ন জায়গায় স্মারকলিপি প্রদান শেষে জেলখানায় সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে দেখা করতে যায় কয়েকজন। অধ্যক্ষ সিরাজের কাছ থেকে নুসরাতকে মারার নির্দেশনা পেয়েছিল বলে নূর উদ্দিন পুলিশকে জানিয়েছে।

‘গত ৫ এপ্রিল সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার দিকে মাদ্রাসার পশ্চিম পার্শ্বের হোস্টেলে তারা এক হয়ে নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করে। দুইটি কারণে তাকে পুড়িয়ে মারার প্রথম প্রস্তাবটি দেয় শামীম। ’

ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, প্রথম কারণ হচ্ছে-নুসরাতের কারণে তাদের অধ্যক্ষকে জেলে যেতে হয়েছে, এর মাধ্যমে অধ্যক্ষ সিরাজসহ সমগ্র আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, শামীম দীর্ঘদিন ধরেই নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে আসছিলো, কিন্তু নুসরাত রাজি হচ্ছিলো না। ফলে নুসরাতের ওপর দীর্ঘদিনের রাগ ছিল শামীমেরও।
‘শামীম এই পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনাটি আরো দুইজন ছাত্রী এবং ৩ জন ছাত্রর কাছে শেয়ার করেছে। এর মধ্য থেকে এক ছাত্রীকে তিনটি বোরকা এবং কেরোসিন আনার দায়িত্ব দেয়া হয়,’ যোগ করেন তিনি।  

বনজ কুমার বলেন, মাদ্রাসাটি পরীক্ষা কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও পরীক্ষা শুরুর আগে সকাল ৭টা থেকে ৯টা পর্যন্ত ক্লাস হয়। ৬ এপ্রিল কথা অনুযায়ী, ওই ছাত্রী পলিথিনে করে কেরোসিন ও বোরকা এনে শামীমের কাছে হস্তান্তর করে। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্লাস ছুটি হওয়ার আগেই তাদের তিনজন টয়লেটে লুকিয়ে ছিল।

‘পরীক্ষা শুরুর কিছুক্ষণ আগে কেন্দ্রে গিয়ে নুসরাতকে এক ছাত্রী বলে, তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদে মারধর করা হচ্ছে। এ কথা বলে ওই ছাত্রী নুসরাতকে ছাদে নিয়ে যায়। পরে সেখানে একপর্যায়ে বোরকা পরিহিত চারজন মিলে ওড়না দিয়ে নুসরাতের হাত-পা বেঁধে ফেলে। আর তখনই কেরোসিন ঢেলে তার শরীরে আগুন দিয়ে সবাই নিচে নেমে আসে। ’

পিবিআই-এর প্রধান বলেন, ঘটনার সময় বাইরে পরিস্থিতি পাহারায় ছিল নূর উদ্দিনের নেতৃত্বে ৫ জন। আগুন দিয়ে বোরকা পরিহিত চারজন নিচে নেমে ভিড়ের সঙ্গে মিশে যায়। ওই চারজনের মধ্যে ন্যূনতম একজন মেয়ে ছিল; যে নুসরাতকে ডেকে ছাদে নিয়ে যায়।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এ ঘটনায় জড়িত শম্পা নামের ওই ছাত্রীকে ইতোমধ্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি তিনজনের মধ্যে শামীম নজরদারিতে রয়েছে, শিগগিরই তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হবে। বাকি দুইজনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে।  

এ হত্যাকাণ্ডে এখন পর্যন্ত মোট ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে জানিয়ে ডিআইজি বনজ কুমার বলেন, এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ১৩ জনের মধ্যে দুইজন ছাত্রী রয়েছেন। এ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি ৬ জনকে গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

‘এর আগেও নুসরাতের চোখে চুন মারা হয়েছিল। সেই ঘটনা তারা চাপা দিতে পেরেছিলো, এমনকি ২৭ মার্চের ঘটনাও সামলে নিয়েছিলো। ফলে তারা ভেবেছিল, নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পর বিষয়টি সামলে নিবে। ’

এই ১৩ জনের মধ্যে মাদ্রাসার গভর্নিং বডির কেউ জড়িত ছিলো কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এখনও অপারেশনে আছি। আফসার উদ্দিন নামে এক শিক্ষককে গ্রেফতার করা হয়েছে, গভর্নিং বডিতে তার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে কি না, বিষয়টি দেখতে হবে। এছাড়া গ্রেফতার কাউন্সিলর মকসুদ গভর্নিং বডির সদস্য।

‘হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট ১৩ জনের বাইরে যদি কেউ বিষয়টি জেনেও থাকে, সে যত পাওয়ারফুলই হোক তাকে গ্রেফতার করা হবে,’ বলেন বনজ কুমার।  

৯ এপ্রিল থেকে পিবিআই মামলাটির তদন্ত শুরু করে জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় আমরা ৮ তারিখ (এপ্রিল) থেকেই ছায়াতদন্ত শুরু করেছিলাম। তাই ৯ তারিখ (এপ্রিল) বিকেলে মামলাটি পাওয়ার পর থেকে আমাদের বুঝে নিতে সমস্যা হয়নি।

‘‘১০ তারিখ (এপ্রিল) থেকে আমাদের দুইজন নারী কর্মকর্তা সার্বক্ষণিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছিলেন। মৃত্যুর আগে নুসরাত বেশ কয়েকবার ‘উস্তাদ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে। ’’

পিবিআই-এর ক্রাইম ও ইন্টেলিজেন্স উইংসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মেট্রো, ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও ময়মনসিংহ ইউনিটের পুরো টিম এ অভিযানে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান পিবিআই-এর প্রধান বনজ কুমার।  

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষার কেন্দ্রে গেলে মাদ্রাসার ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে পালিয়ে যায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা।  

এ সময় মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা যৌন হয়রানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় তারা।  

পরে আগুনে ঝলসে যাওয়া নুসরাতকে প্রথমে স্থানীয় হাসপাতালে এবং পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার চিকিৎসায় গঠিত হয় ৯ সদস্যের মেডিকেল বোর্ড।  
সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুসরাতকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোরও পরামর্শ দেন তিনি। কিন্তু সবার প্রার্থনা-চেষ্টাকে বিফল করে ১০ এপ্রিল রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ‘প্রতিবাদী’ নুসরাত।

এদিকে ওই ছাত্রীর পরিবারের অভিযোগ, ২৭ মার্চ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা তার কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। তারই জেরে মামলা করায় নুসরাতকে আগুনে পোড়ানো হয়। ওই মামলার পর সিরাজ উদ-দৌলাকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৩, ২০১৯/আপডেট: ১৬০৭ ঘণ্টা
পিএম/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।