ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘মেয়ের শরীর পুড়েছে, আমার কলিজাও’

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০১৯
‘মেয়ের শরীর পুড়েছে, আমার কলিজাও’ ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে মেয়ের পাশে মা শিরিন

ঢাকা: ‘মা-গো ও মা, তুমি ভালো হয়ে যাবা। তোমাকে সুস্থ করার জন্য কত ডাক্তার কাজ করছে। তোমার ভয় নেই মা, তুমি সুস্থ হয়ে যাবা’।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন ফেনীর দগ্ধ সেই ছাত্রীকে দেখতে ভেতরে যান তার মা শিরিন আক্তার। এ সময় মায়ের মমতায় মেয়েকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করেন।

কিন্তু আগুনে তার শরীরের বেশিরভাগ অংশ পুড়ে যাওয়ায় মায়ের মমতায় আগলে ধরা সম্ভব হয়নি।

হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করা মেয়েকে দেখার পর শিরিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিজেই বলতে থাকেন, আমার নারীছেঁড়া ধন নুসরাতের শরীর পুড়ে গেছে, আমার কলিজাও পুড়ে গেছে।

দু’দিন আগেও নুসরাত শরীরের জ্বালাপোড়া নিয়ে অনেক কথা বলার চেষ্টা করেছে। মেয়ের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করে তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছি, তোমার কিছু হবে না মা, তুমি ভালো হয়ে যাবে। কথাগুলো বলতে বলতে গলা ধরে আসে মা শিরিনের। অবুঝ মা আবারো বলতে থাকেন, মা-গো ও মা, তোমাকে সুস্থ করার জন্য কত ডাক্তার কাজ করছে। তোমার কিছুই হবে না, তুমি সুস্থ হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী তোমার জন্য দোয়া করছেন, চিকিৎসার খোঁজ খবর রাখছেন।

দু’দিন আগেও আইসিইউতে গিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে মায়ের মমতা দিয়ে সুস্থ রাখার চেষ্টা করেছি। এখন মেয়ে আমার মেশিনের সাহায্য শ্বাস নিচ্ছে, কাঁদতে কাঁদতে বলেন শিরিন।

দগ্ধ ওই ছাত্রীর ভাইয়ের ভাষ্যে, গত ২৭ মার্চ সকাল পৌনে ১২টার দিকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা তার পিয়ন নুরুল আমিনকে দিয়ে সেই ছাত্রীকে নিজের কক্ষে ডেকে নেন। তখন সেই ছাত্রী নিজের সঙ্গে আরও তিন থেকে চার জন বান্ধবীকে নিয়ে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকতে চাইলে সিরাজউদ্দোলা অন্যদের ঢুকতে না দিয়ে কেবল সেই ছাত্রীকে নিয়ে যান। এরপর দরজা আটকে তিনি ওই ছাত্রীকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখান। এমনকি পরীক্ষার আধঘণ্টা আগে তাকে প্রশ্নপত্র দেওয়া হবে জানিয়ে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়। এরপর সিরাজউদ্দৌলা ওই ছাত্রীর শরীর স্পর্শ করার চেষ্টা করলে সেখানে কিছুক্ষণ ধস্তাধস্তি হয়। এক পর্যায়ে ওই ছাত্রী দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে বাইরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যায়। তখন খবর পেয়ে মাদ্রাসায় থাকা ওই ছাত্রীর ছোট ভাই অধ্যক্ষের কক্ষে ছুটে যায়। অধ্যক্ষ তখন তাকে জানান, তার বোন অসুস্থ। সেজন্য ছুটির আবেদন করতে এসে পড়ে যায়।

সেখান থেকে ওই ছাত্রীকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হলে ওই ছাত্রী কিছুটা সুস্থ হয়। তখন সে স্বজনদের জানায়, মাদ্রাসার অধ্যক্ষ তার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছিলেন। এরপরে ক্ষুব্ধ হয়ে স্বজনরা মাদ্রাসায় গিয়ে অধ্যক্ষকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। তবে তিনি ওই অভিযোগ অস্বীকার করেন। এরপর মাদ্রাসা অধ্যক্ষই উপজেলা আওয়ামী লীগের এক নেতাকে ফোন করেন। আওয়ামী লীগের নেতা পুলিশসহ মাদ্রাসায় যান। তবে মাদ্রাসায় গিয়ে সব ছাত্র-ছাত্রীর মাধ্যমে সত্য ঘটনা জানতে পেরে পুলিশ অধ্যক্ষকেই আটক করে থানায় নিয়ে যায়। এরপর ওই ছাত্রীর মা বাদী হয়ে শ্লীলতাহানি অভিযোগে মামলা দায়ের করেন। মামলায় পরের দিন সিরাজউদ্দৌলাকে আদালত পাঠানো হয়। আদালত তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠায়।

দগ্ধ করার ঘটনার বর্ণনায় ওই ছাত্রীর ভাই জানান, শনিবার (৬ এপ্রিল) আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা ছিলো তার বোনের। সকালে মাদ্রাসায় গেলে একজন ওই ছাত্রীকে বলে যে, তার এক বান্ধবীকে কারা যেনো ছাদে মারধর করছে। এ কথা শুনে সে তখনই সেখানে ছুটে যায়। কিন্তু সেখানে বোরকা পরা চারজন ওই ছাত্রীকে ঘিরে ধরে এবং অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেয়। এই চাপ প্রত্যাখ্যান করায় সেই চারজন প্রথমে তাকে কিল-ঘুষি মারে। এক পর্যায়ে তারা সেই ছাত্রীর গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় ছাত্রীর চিৎকার শুনে সেখানে ছুটে যান পরীক্ষাকেন্দ্রে দায়িত্বরত পুলিশ কনস্টেবল রাসেল ও মাদ্রাসার অফিস সহকারী মোস্তফা। পরে তারা ছাত্রীর গায়ে কার্পেট জড়িয়ে আগুন নেভান।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৯, ২০১৯
এজেডএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।