ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

হানাদারদের আতঙ্কের নাম ছিল ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির’

স্বপন চন্দ্র দাস, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৯
হানাদারদের আতঙ্কের নাম ছিল ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির’ পলাশডাঙ্গা যুবশিবির স্মুতি পাঠাগারে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা। ছবি: বাংলানিউজ

সিরাজগঞ্জ: ২৫ মার্চ রাতেই পাকিস্তানী সেনারা সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শহরে ঢুকে দেশীয় দোসরদের সহায়তায় শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। আতঙ্কিত মানুষ শহর ছাড়তে শুরু করে। মাসব্যাপী চলতে থাকে তাদের অত্যাচার। 

২৪ এপ্রিল পাক হানাদার বাহিনীর আরও একটি দল পাবনার ঈশ্বরদী থেকে ট্রেনে করে আসার পথে ঘাটিনা রেলওয়ে সেতুর কাছে প্রথম প্রতিরোধে মুখে পড়ে। তুখোর ছাত্রনেতা ও সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজ সংসদের সাবেক ভিপি আব্দুল লতিফ মির্জার নেতৃত্বে তিন ঘণ্টাব্যাপী চলা সম্মুখযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পরাজিত হয়ে পিছু হটে পাক হানাদার বাহিনী।

আর এ যুদ্ধটি সিরাজগঞ্জের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধ হিসেবে স্বীকৃত। এরপরই লতিফ মির্জাসহ মহুকুমা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রশিক্ষণ নিতে ভারতে চলে যান।

এদিকে ভারতে যাওয়ার সময় মুলাডুলি রেলওয়ে স্টেশনে বাধার মুখে ফিরে আসেন ৫ ছাত্রনেতা। এরা হলেন, সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজের ভিপি সোহরাব আলী সরকার, প্রো-ভিপি লুৎফর রহমান মাখন, আজিজ সরকার, শফিকুল ইসলাম শফি ও মনিরুল হায়দার। পাকিসেনা ও রাজাকারদের দৃষ্টি এড়িয়ে তারা মুক্তিকামী যুবকদের সন্ধানে গ্রামে গ্রামে ঘুরছিলেন। একপর্যায়ে কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের জাঙ্গালিয়াগাঁতী ওছিম উদ্দিনের বাড়িতে আশ্রয় নেন ওই ৫ ছাত্রনেতা।  

উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। এ অবস্থায় জহির উদ্দিনের নেতৃত্বে ১০/১২ জন যুবক ও কান্দাপাড়া গ্রাম থেকে ১৫ জনের আরও দু’টি দল আসে জাঙ্গালিয়াগাঁতীতে। ওছিম উদ্দিনের বাড়িতে জায়গা না হওয়ায় পার্শ্ববর্তী ভদ্রঘাটের হালদার পাড়ায় হারান চন্দ্র মাস্টারের বাড়িতে আশ্রয় নেন সবাই। পরবর্তীকালে হারান মাস্টারের দু’টি টিনের ঘর তারা ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেন। গ্রামের লোকজন এ ক্যাম্পটিতে খাদ্য সরবারহ করতেন।

কিছুদিন পর সেনা সদস্য প্রয়াত লুৎফর রহমান অরুনও পালিয়ে চলে আসেন এই ক্যাম্পে। শুরু হয় যুবকদের প্রশিক্ষণ পর্ব। ধীরে ধীরে গ্রামগঞ্জের শত শত মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা, কৃষক, শ্রমিক এ ক্যাম্পে এসে যোগ দেন।  

অপরদিকে ভারতে প্রশিক্ষণ শেষে ফিরে এই দলেই যুক্ত হন আব্দুল লতিফ মির্জা, বিমল কুমার দাস, শহীদুল ইসলাম, আমিনুল ইসলাম হীরু, খোরশেদ আলমসহ ২০/২৫ মুক্তিযোদ্ধা। দাঁড়িয়ে যায় একটি বেসামরিক বাহিনী। ৬ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাহিনীর নামকরণ করা হয় ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির’। সবার সম্মতিক্রমে আব্দুল আজিজ সরকার এই নামকরণ করেন। প্রয়াত আব্দুল লতিফ মির্জাকে (সাবেক এমপি) পরিচালক, রাকসুর সাবেক জিএস আব্দুস সামাদ ও মনিরুল কবিরকে সহকারী পরিচালক ও সিরাজগঞ্জ কলেজের ভিপি সোহরাব আলীকে অধিনায়ক (কমান্ড ইন চার্জ) নিযুক্ত করা হয়। সহকারি অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয় তুখোর ছাত্রনেতা বিমল কুমার দাস ও আমজাদ হোসেন মিলনকে (সাবেক এমপি)। আর ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লুৎফর রহমান অরুনের অধীনে থাকে কয়েকটি কোম্পানি। প্রতি কোম্পানিতে একাধিক সেকশনে সাজানো হয় এই বাহিনীকে।  

গাজী আব্দুর রহিম, লুৎফর রহমান মাখন, আব্দুল আজিজ সরকার, আক্তার হোসেনসহ পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের একাধিক মুক্তিযোদ্ধা বলেন, খুবই গোপনে অজ পাড়াগায়ে সংগঠিত পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের অস্তিত্ব টের পেয়ে যায় পাকিসেনা ও তাদের দোসর রাজাকাররা।  

১৭ জুন ভোরে হঠাৎ করেই ভদ্রঘাটের ক্যাম্পটিতে আক্রমণ চালায় পাকিসেনারা। তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শিবিরের শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা। প্রচণ্ড যুদ্ধে এক পাকি সেনার মৃত্যু হয়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সেনাদের আরও একটি ব্যাটালিয়ন এসে উপুর্যপুরি আক্রমণ চালায় মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর। বাধ্য হয়ে পিছু হটে যায় তারা। আর এখান থেকেই শুরু হয় বেসরকারি সাব সেক্টর পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরে যাত্রা।  

তারা ভদ্রঘাট থেকে সংঘবদ্ধভাবে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরতে থাকে। একের পর এক পাকি-সেনা ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের বাহিনী। ধীরে ধীরে যোদ্ধার সংখ্যা বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে প্রায় ৬শ’ যোদ্ধার বিশাল এক বাহিনীতে রূপ নেয় ‘পলাশ ডাঙ্গা যুবশিবির’। সমগ্র উত্তরাঞ্চলে পাকিসেনা ও রাজাকারদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয় ‘পলাশডাঙ্গা যুবশিবির’।

প্রথম দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের যোগান কম ছিল। তবে বিভিন্ন থানা লুট করে ও রাজাকার-পাকিবাহিনীদের সঙ্গে যুদ্ধে ছিনিয়ে আনা অস্ত্রেই সমৃদ্ধ হতে থাকে পলাশডাঙ্গা যুবশিবিরের অস্ত্রভান্ডার।  

মুক্তিযুদ্ধকালীন পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অধিনায়ক (চিফ ইন কমান্ড) ও সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার গাজী সোহরাব আলী সরকার বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের সব যোদ্ধাদের মধ্যে ছিল অদম্য দেশপ্রেম। হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের সামনে মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পিছপা হইনি। আমাদের বাহিনীটাও ছিল সুসজ্জিত। ভদ্রঘাটের ক্যাম্প ছাড়ার পর আমরা নির্দিষ্ট কোনো স্থানে বেশিদিন অবস্থান করিনি। পরিকল্পনা মাফিক রেকি করে এক একটি এলাকায় অবস্থান ও পাক সেনাদের ওপর আক্রমণ করেছি। নদীপথেও ছিল আমাদের বিচরণ। ৫৪টি নৌকা নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরেছি।  

তিনি আরো বলেন, মোট ৫৪টি ছোটবড় যুদ্ধে আমরা অংশ নিয়েছি। তার মধ্যে বৃহৎ আকারের যুদ্ধ ছিল ১৮টি। উত্তরাঞ্চলের সবচেয়ে বড় গেরিলা যুদ্ধ সংগঠিত হয় তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ শাহ শরীফ জিন্দানীর (রহ.) মাজার এলাকায়। ১১ নভেম্বরের এই যুদ্ধটি পলাশডাঙ্গা যুব শিবিরের অন্যতম সাফল্য। এ যুদ্ধে ১৩০ জন পাকিসেনা ও রাজাকার নিহত হয় এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ পাকিসেনা আত্মসমর্পণ করে। তবে এ যুদ্ধে কোনো মুক্তিযোদ্ধা নিহত হননি। এছাড়াও পাবনার ফরিদপুর, সাঁথিয়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নাটোরের গুরুদাসপুর থানার অস্ত্রলুট। কালিয়া হরিপুর যুদ্ধ ছিল অন্যতম।  

তিনি বলেন, পলাশডাঙ্গা যুবশিবির পরবর্তীতে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বেসরকারি সাব সেক্টর হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ সংগঠনের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও কৌশলের কাছে বেশিরভাগ যুদ্ধেই পরাজিত হয়েছে হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসররা। এসব যুদ্ধে অসংখ্য পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হলেও শহীদ হননি কোনো গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। তবে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছিলেন।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৫ ঘণ্টা, মার্চ ২৫, ২০১৯
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।