ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

নিষেধাজ্ঞার পরও চলছে বিজ্ঞাপন-পুরস্কার-প্রণোদনা!

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৯
নিষেধাজ্ঞার পরও চলছে বিজ্ঞাপন-পুরস্কার-প্রণোদনা! ছবি: বাংলানিউজ

রাজশাহী: বিদ্যমান আইনে পয়েন্ট অব সেল বা তামাকের বিক্রয় কেন্দ্রে যে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন, প্রণোদনা, পুরস্কার বিতরণ বা উপহার প্রদান ও তামাক পণ্য বিতরণ বা এর প্রচার নিষিদ্ধ।

এরপরও তামাক কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যের প্রকাশ্য প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই ব্যাপারে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।

 

এত কিছুর পরও টনক নড়ছে না কারও। ফলে রাজশাহীতে তামাক কোম্পানিগুলো ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন লঙ্ঘন করেই চলেছে। যেন দেখার কেউ নেই!

আইন লঙ্ঘন করে মহানগরীর পাবলিক প্লেসগুলোতেও দেদারছে চলছে ধূমপান। ফলে তামাকের ধোঁয়ায় গ্রীন, ক্লিন, এডুকেশন ও হেলদি সিটি হিসেবে পরিচিত এই রাজশাহীতে প্রতিনিয়ত ঘটছে স্বাস্থ্যহানির ঘটনা। তামাক কোম্পানী ও দোকানিরা এভাবে দিনের পর দিন আইন অমান্য করে চললেও কর্তৃপক্ষ যেন কোনো ব্যবস্থাই নিচ্ছে না। তাই নগরবাসী রাজশাহীতে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোরালো দাবি জানিয়েছেন।  

সম্প্রতি পয়েন্ট অব সেল বা তামাক বিক্রয়কেন্দ্র নিয়ে জরিপ চালিয়েছে রাজশাহীতে কর্মরত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন ফর কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট-এসিডি’।  

বেসরকারি এই সংস্থাটির জরিপ অনুযায়ী মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের ২ হাজার ৭৩৬টি দোকানে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের তামাকপণ্য বিক্রয় করা হচ্ছে। এর মধ্যে ১ নম্বর ওয়ার্ডের ৮৪টি দোকানে তামাকপণ্য বিক্রি হয়, ২ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৫টি, ৩ নম্বর ওয়ার্ডে ১০৭টি, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১০০টি, ৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৮টি, ৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৬টি, ৭ নম্বর ওয়ার্ডে ৬২টি, ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৯টি, ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৫টি, ১০ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৩টি, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ৪০টি, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে ১৪৪টি, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৭টি, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডে ১২৭টি, ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৯৩টি, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে ৯৭টি, ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১৩০টি, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৮৬টি, ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে ১২১টি, ২০ নম্বর ওয়ার্ডে ৪৬টি, ২১ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৩টি, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে ৫৯টি, ২৩ নম্বর ওয়ার্ডে ৫০টি, ২৪ নম্বর ওয়ার্ডে ৯০টি, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে ৬৬টি, ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫১টি, ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে ১১৮টি, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে ১৫৮টি, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে ৭৮টি এবং ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯৩টি দোকানে বিক্রি হয় তামাকপণ্য।

ছবি: বাংলানিউজএদিকে, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ সংশোধন) আইন, ২০০৫ (২০১৩) এর ধারায় বলা আছে- বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্যের প্যাকেট বা মোড়ক সাদৃশ্য কোনো দ্রব্য, লিফলেট, হ্যান্ডবিল, পোস্টার, ছাপানো কাগজ, বিলবোর্ড, সাইনবোর্ড বা অন্য কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করা যাবে না। এছাড়া তামাকে উৎসাহিত করতে কোনো উপহার, দান, পুরস্কার, বৃত্তি প্রদান দণ্ডনীয় ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আইনের এই ধারা অমান্যকারীকে তিন মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।  

তবে মহানগরীর এসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ২ হাজার ৭৩৬টির অধিকাংশ দোকানে লঙ্ঘিত হচ্ছে এ আইন। ৩০টি ওয়ার্ডের এসব দোকানের প্রায় অর্ধেক দোকানে বিভিন্ন সিগারেট কোম্পানি ডামি সিগারেটের প্যাকেটে ডেকোরেশন করে দেওয়া হয়েছে। দোকানে দোকানে শোভা পাচ্ছে- সিগারেট কোম্পানীগুলোর হ্যান্ডবিল, স্টিকার ও লিফলেট। দোকানগুলোর দোকানীকে তারা দিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের উপহার। এর মধ্যে রয়েছে- শোকেস, দোকানির ছবিসহ পান-সিগারেটের বাক্স, গেঞ্জি, ছাতা, ঘড়ি, মগ ইত্যাদি। এছাড়া সিগারেট-বিড়ি কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারিরা কোম্পানির লোগো সম্বলিত শার্ট-প্যান্ট পরে অবাধে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে।   

মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২২টি ওয়ার্ডে ১০৬টি তামাকপণ্যের দোকান বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ১০০ গজের মধ্যে রয়েছে। এসব দোকান  শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে গড়ে তোলা হয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন অনুযায়ী- ১৮ বছরের কম কোনো ব্যক্তির নিকট তামাকপণ্য বিক্রি নিষিদ্ধ। আইনের এই বিধান অমান্যকারীর অনধিক ৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। অথচ শতাধিক দোকানে আইন লঙ্ঘন করে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রি করা হচ্ছে তামাকপণ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে তামাকপণ্যের দোকান থাকায় অনেক শিক্ষার্থী আসক্ত হচ্ছে ধূমপানে।       

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মহানগরীর বিভিন্ন পাবলিক প্লেস যেমন হাসপাতাল চত্বর, বাস টার্মিনাল, যাত্রী ছাউনি, গণপরিবহন, সরকারি বিভিন্ন অফিস, আদালত চত্বর, আবাসিক হোটেল, রেস্টুরেন্ট, খাবার হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভবন ইত্যাদিতে যত্রতত্র করা হচ্ছে ধূমপান।  

ছবি: বাংলানিউজএ ব্যাপারে কথা বলতে গেলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর রাজশাহীর সমন্বয়ক সুব্রত পাল বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন একটি দুর্বল আইন। তারপরও এ আইনের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন না হওয়ায় তামাক কোম্পানিগুলো যেমন অবৈধ প্রণোদনা ও বিজ্ঞাপন ছড়াচ্ছে তেমনি লাখ লাখ মানুষ পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হচ্ছে। এজন্য আইন সংশোধন করে জেল-জরিমানার বিধান করা উচিত। পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন সুব্রত পাল।

রাজশাহী রক্ষা সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জামাত খান বলেন, ‘তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের জন্য মহানগরীর অভ্যন্তরে তামাকপণ্যের অবৈধ বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে হবে। পাশপাশি নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পাবলিক প্লেসে ধূমপান বন্ধে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিও আকর্ষণ করেন তিনি।

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের বাস্তবায়ন প্রশ্নে রাজশাহী জেলা প্রশাসক (ডিসি) এসএম আব্দুল কাদের বলেন, ‘রাজশাহীকে তামাকমুক্ত রাখতে বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়। তবে সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ব্যস্ততা যাচ্ছে। এজন্য মোবাইল কোর্টের হার এ বছর কম। কিন্তু শিগগিরই মোবাইল কোর্ট চালুর কথা জানান জেলা প্রশাসক।  

তবে ২০০৮ সালে মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী সিটিকে তামাকমুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন। মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন জানান, ‘আমি দায়িত্বে না থাকায় উদ্যোগটি তখন আর আলোর মুখ দেখেনি। তবে এবার দায়িত্ব নেওয়ার পর কাজ শুরু করেছি। আশা করছি, এবার উদ্যোগটি সফল হবে। '

বাংলাদেশ সময়: ২২৫৫ ঘণ্টা, মার্চ ১৯, ২০১৯
এসএস/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।