ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

খাগড়াছড়ি পাসপোর্ট অফিসে টাকা দিলে হাঁটে ফাইল!

অপু দত্ত, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৪ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৯
খাগড়াছড়ি পাসপোর্ট অফিসে টাকা দিলে হাঁটে ফাইল! পাসপোর্ট অফিসে ছবি তোলা হচ্ছে। ছবি: বাংলানিউজ

খাগড়াছড়ি: ঘুষ ছাড়া এক ঘর থেকে অন্য ঘরে যায় না খাগড়াছড়ি পাসপোর্ট অফিসের কোনো ফাইল। ফরম সংগ্রহ থেকে শুরু করে পাওয়া পর্যন্ত, অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে প্রধান কর্তা পর্যন্ত সবাইকে নানা অজুহাতে দিতে হয় ‘অফিস খরচ’!

খরচের পরিমাণটাও রীতিমতো অবাক করার মতো। আর না দিলে মিলবে অন্তহীন ভোগান্তি।

শুধু তাই নয়, পুলিশের নাম করেও নেওয়া হচ্ছে মোটা অংকের টাকা।

খাগড়াছড়ির জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্সে পাসপোর্ট অফিস চালু হওয়ার বছর পূর্ণ হওয়ার আগে থেকে স্থানীয়দের পাহাড়সম অভিযোগ জমে যায়। পাসপোর্ট করতে গিয়ে রীতিমতো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সবাইকে। সব ঠিক থাকার পরও নানা ছুঁতো দিয়ে টাকা চেয়ে বসেন অফিসের কর্মকর্তারা। আবার পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নেওয়া হয় আলাদা টাকা। এতে অতিষ্ট স্থানীয়রা।

এদিকে পাসপোর্ট অফিসে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ অফিস সহকারী শিপন হোসেনের বিরুদ্ধে। তিনি প্রত্যেকটা ফাইল থেকে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে নেন বলে জানান ভুক্তভোগীরা। এ নিয়ে কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ করতে গেলে উল্টো হুমকি ধমকি দেওয়া হয়।

আবার পাসপোর্ট অফিসের অনিয়মের খবর সংগ্রহ করতে যাওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর দফতরসহ বিভিন্ন মন্ত্রী ও লোকের প্রভাব দেখিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মিটমাট করার চেষ্টা করেন অভিযুক্ত কর্মকর্তারা। পুলিশের নাম ভাঙিয়ে টাকা নেওয়ায় ক্ষুদ্ধ পুলিশ প্রশাসন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাসপোর্ট ফরমে সবকিছু ঠিক থাকার পরও কর্মকর্তারা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পুনরায় ফরম পূর্ণ করে জমা দেওয়ার কথা বলেন। তবে অতিরিক্ত অর্থ দিলে নিজেরা ফরমটি ঠিক করে দেবেন বলে জানান। তার জন্য ১৫শ টাকা থেকে থেকে ২ হাজার টাকা দাবি করা হয়। পাশাপাশি পুলিশি যাচাই-বাছাইয়ের জন্য চাওয়া হয় আরো ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। আর টাকা দিতে না চাইলে স্বাক্ষর দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

২০১৩ সালের শেষের দিকে খাগড়াছড়িতে পাসপোর্ট অফিসটি চালু হয়। এর আগে রাঙামাটিতে গিয়ে পাসপোর্ট করতে হতো। তবে হাতের নাগালে থাকা পাসপোর্ট অফিসের ভোগান্তি অনেকটা একই বলছেন স্থানীয়রা।

সবশেষ ১৩ মার্চ মাটিরাঙ্গার বাসিন্দা মহেন্দ্র ত্রিপুরা ও দীঘিনালার বাসিন্দা জনি মারমা পাসপোর্ট করতে গেলে অফিস সহকারী শিপন হোসেন দু’টি ফরমের জন্য তিন হাজার টাকা দাবি করেন। এছাড়া আনোয়ার হোসেন থেকে পুলিশি যাচাই-বাছাই বাবদ চাওয়া হয় ২ হাজার ৭শ টাকা। এসময় তারা অতিরিক্ত অর্থ দিতে অপারগতা জানালে তাদের ফরম দু’টি ফেরত দেওয়া হয়। এ বিষয়ে তারা লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন। প্রথমে জোর করে মীমাংসার চেষ্টা করা হলেও পরে অভিযোগটি নিতে বাধ্য হয়।

মহেন্দ্র ত্রিপুরা ও জনি মারমা বলেন, আমাদের ফরম দু’টি দেখে প্রথমে অনেক ভুল আছে বলে জানান। পরে দু’টি ফরমে স্বাক্ষরের জন্য ৩ হাজার টাকা দাবি করে। এতো টাকা কেন জানতে চাইলে তিনি অফিসার আর অফিস খরচ বলে জানান। আমরা টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তিনি ফাইল দু’টি ফেরত দিয়ে পরে যোগাযোগ করতে বলেন।

মাটিরাঙ্গার তবলছড়ি এলাকার বাসিন্দা আনোয়ার হোসেন বলেন, প্রথমে পাসপোর্টে ভুল আছে বলে জানান। পরে ঠিক করে আনার পর বলে পুলিশ যাচাই-বাছাই বাবদ ২ হাজার ৭শ টাকা দিতে হবে। টাকা দিতে না পারায় ফাইল ফেরত দিয়েছে। সরকারি অফিসে যদি এভাবে টাকা দিতে হয় তাহলে আমরা কার কাছে যাবো। কার কাছে প্রতিকার পাবো।

তবে অফিসে সাংবাদিকদের উপস্থিতি দেখে পরে আবুল হোসেনের ফাইলটিতে কর্মকর্তারা স্বাক্ষর করেন।

ঘুষ চাওয়ার অভিযোগ দিতে গিয়ে উল্টো হেনস্তার শিকার হয়েছেন খাগড়াছড়ির বিলিভার্স চার্চের ফাদার রাজেন্দ্র ত্রিপুরা। তিনি বলেন, আমি পাসপোর্ট অফিসের সহকারী শিপনের বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়ায় অভিযোগ দিতে গেলে আমাকে হয়রানি করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে তার লোক আছে জানিয়ে অভিযোগপত্র ফেরত নিতে চাপ প্রয়োগ করে। এমনকি একটি সাদা কাগজে সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করতে বলেন। পরে বাধ্য হয়ে অভিযোগটি গ্রহণ করেন।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পাসপোর্ট অফিস নিয়ে বিস্তর অভিযোগ তুলেছেন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী। অফিস সহকারী শিপনের বিরুদ্ধে তুলেছেন সবচেয়ে বেশি অভিযোগ। এরমধ্যে প্রমিজ দে নামে এক ভুক্তভোগী বলেন, ‘৫শ টাকা দেওয়ার পর আমার ফরমে স্বাক্ষর করেছে’। প্রিয়াংকা দে নামে অপর ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার ফাইলে স্বাক্ষর করার জন্য ১ হাজার টাকা নিয়েছিল। ’ টিনা দেওয়ান বলেন, ‘আমার পাসপোর্ট নবায়ন করতে ১ হাজার টাকা এবং মেয়ের জন্য নতুন পাসপোর্ট করতে নিয়েছে ১ হাজার ৫শ টাকা।

এ বিষয়ে প্রধান অভিযুক্ত অফিস সহকারী শিপন হোসেন সব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন। প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কে আছেন জানতে চাইলে তিনি কিছু বলতে রাজি হননি। দফায় দফায় ওই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার প্রস্তাব দেন।

অফিসে কোনো রকম অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয় না এবং এসব বিষয়ে নিজের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে খাগড়াছড়ি পাসপোর্ট অফিসের আঞ্চলিক উপ-সহকারী পরিচালক শওকত কামাল বলেন, এ বিষয়ে কেউ লিখিত অভিযোগ দাখিল করেনি। অভিযোগ পেলে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশ মোতাবেক ব্যবস্থা নেবো।

পুলিশের নামে টাকা তোলার বিষয়ে খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আহমার উজ্জামান বলেন, পাসপোর্টের যাচাই-বাছাই পুলিশের রুটিন কাজ। আমাদের নাম ভাঙিয়ে টাকা দাবি করা ভয়াবহ অপরাধ। বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।

এ বিষয়ে খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক (ডিসি) শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, যেখানে প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন, সেখানে এমন অনিয়ম গ্রহণযোগ্য নয়। পাসপোর্ট অফিসের আঞ্চলিক কর্মকর্তা অভিযোগের বিষয়ে কি ব্যবস্থা নেন দেখবো। প্রয়োজনে আমরা তদন্ত কমিটি গঠন করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশ সময়: ০৮১২ ঘণ্টা, মার্চ ১৬, ২০১৯
এডি/এসএইচ/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।