ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সিন্ডিকেটে জিম্মি সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর

মাহফুজুর রহমান পারভেজ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৯
সিন্ডিকেটে জিম্মি সোনারগাঁ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের লেকে কাঠের তৈরি ১১ নৌকার পরিবর্তে ইজারাদাররা প্রভাব খাটিয়ে প্লাস্টিকের নৌকাসহ ১৭টি নৌকা ব্যবহার করছেন।

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (জাদুঘর) চলে গেছে ইজারাদার, দখলদার আর এক শ্রেণীর অসৎ কর্মচারীদের নিয়ন্ত্রণে। প্রতিষ্ঠানটির পরতে পরতে অনিয়ম-দুর্নীতি। আর এসবের হর্তাকর্তা ১২ সদস্যের একটি সিন্ডিকেট। মূলত তাদের হাতেই জিম্মি গোটা ফাউন্ডেশন।

নানা অনিয়মের মাধ্যমে ওই সিন্ডিকেট ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন স্পট ইজারা নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, ওই সিন্ডিকেটে একাধিক কর্মচারীও জড়িত।

 

ফাউন্ডেশনের গাড়ি পার্কিং, নাগরদোলা, খালের পানিতে নৌকা ভ্রমণ, মৌসুমী ফল ইজারা, কনফেকশনারি, সেলস সেন্টার ইজারার মাধ্যমে ফাউন্ডেশন দখলে রেখেছে ওই সিন্ডিকেট।  

অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় একটি ক্লাবের কয়েকজন নেতা পুরো লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন নিয়ন্ত্রণ করছেন। প্রতিদিন এ সিন্ডিকেটের কাছে হয়রানির শিকার হচ্ছেন  সোনারগাঁয়ে আগত দর্শনার্থীরা। হয়রানির শিকার অনেক পর্যটক লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আবেদন করেও কোনো ফল পাচ্ছে না। এ নিয়ে অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সোনারগাঁয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটকের উল্টো দিকে সরকারি জমি দখল করে টাইগার ক্লাব নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। সংগঠনটির কার্যালয় বর্তমানে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকলেও সভাপতি নূরে আলম কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের একাধিক কর্মচারীকে নিয়ে ১২ জনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। সিন্ডিকেটটি এলাকায় ‘১২ খলিফা’ নামে পরিচিত।

অভিযোগ রয়েছে, কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের কার পার্কিংটি ২০০৮ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ওই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে। এই সিন্ডিকেটের বাইরের কেউ কার পার্কিংয়ের ইজারায় দরপত্র কিনলেও রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে, ভয়ভীতি ও কাগজপত্র সঠিক নয় উল্লেখ করে নানা কৌশলে তা বাতিল করে দেওয়া হয়। ওই সিন্ডিকেটের অংশীদার অসাধু কর্মচারী ফাউন্ডেশনের দরপত্রের তথ্য ফাঁস করে তাদের দরপত্র পাইয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেন।  

প্রতিবছর তাদের নিয়ন্ত্রিত লোক দিয়ে ইজারা নেওয়ার পর শুরু হয় পর্যটকদের হয়রানি। গাড়ি পার্কিংয়ে সরকার নির্ধারিত ফি’র বাইরে অতিরিক্ত টাকা আদায়, রাস্তায় গাড়ি রাখলেও সেখান থেকে চাঁদা উত্তোলন, নিয়ম বহির্ভূতভাবে পার্কিং জোনের ভেতরে অনেক চটপটির দোকান, চায়ের দোকান, আইসক্রিমের দোকান ও কারুপণ্যের দোকান বসিয়ে সেখান থেকে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করছে ওই সিন্ডিকেট।  

ফাউন্ডেশনের প্রধান ফটকের সামনে যত্রতত্র অপরিকল্পিতভাবে দোকানপাট বসিয়ে চাঁদাবাজি করার কারণে প্রতিনিয়ত প্রধান সড়কে সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। এ কারণে প্রতিদিন শতশত পর্যটক চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।

সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের গাড়ি পার্কিং ইজারা নিয়ে পার্কিং জোনে টাকার বিনিময়ে যত্রতত্র বসানো হয়েছে দোকানপাট।

ফাউন্ডেশনের ১২ জনের সিন্ডিকেটে মধ্যে রয়েছেন- নূর আলম, পিয়ার হোসেন, মনির হোসেন, হেলাল, কৃষ্ণ চন্দ্র সাহা, ফজল, শাহীন, আবু সাইদ, লুৎফর ফাউন্ডেশনের গাড়ি চালক বুলবুল, ইলেকট্রিশিয়ান সাইদুর রহমান, ক্যামেরাম্যান জজ মিয়া।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক ব্যক্তি জানান, লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের অভ্যন্তরে লেকে বেড়ানোর যে নৌকা তা প্রভাব খাটিয়ে ইজারার মাধ্যমে গত এক যুগ ধরে নিজেদের দখলে রেখেছে ১২ খলিফা খ্যাত এ সিন্ডিকেট। লেকের প্লাস্টিকের নৌকার অনুমোদন না থাকলেও এই সিন্ডিকেট প্রভাব খাটিয়ে কাঠের নৌকার পাশাপাশি ৮টি প্লাস্টিকের নৌকা ব্যবহার করছেন। এমনকি ইজারায় যত সংখ্যক নৌকা চলার অনুমতি দেওয়া হয়েছে তা থেকে দ্বিগুণেরও বেশি নৌকা ব্যবহার করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করছে।  

নৌকা ভ্রমণের জন্য ঘণ্টায় সরকার নির্ধারিত নৌকা ফি’র দ্বিগুণেরও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের ভেতরে নাগরদোলা, চরকা, মিনি ট্রেন ও ইলেক্ট্রিক নৌকাও নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এ সিন্ডিকেটের হাতে। বছরের পর বছর ধরে ফাউন্ডেশনের মৌসুমী ফলমূল প্রভাব খাটিয়ে ও কৌশলে ইজারা নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এ সিন্ডিকেট। প্রতিবছর স্বল্পমূল্যে ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ফলমূলের বাগান ইজারা নিয়ে অন্যত্র কয়েকগুণ বেশি মূল্যে বিক্রি করে তারা। এই সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে অন্য কেউ ফাউন্ডেশনের ফলের বাগান ইজারা নিতে পারে না।

সরেজমিনে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন ঘুরে দেখা যায়, এর অভ্যন্তরে অপরিকল্পিতভাবে ১৩টি কনফেকশনারি দোকান বসানো হয়েছে। এসব দোকানের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণে রেখেছে এ সিন্ডিকেট। অভিযোগ রয়েছে, এতসব অনিয়মে প্রকাশ্যে ও পরোক্ষভাবে ফাউন্ডেশনের একজন ইলেকট্রিশিয়ান ও পরিচালকের একজন ড্রাইভার বুলবুল জড়িত থাকালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।  

ভুক্তভোগী মইন আল হোসেন অভিযোগ করেন, তিনটি বাস নিয়ে ফাউন্ডেশনে পিকনিকে এসে পার্কিংয়ে রাখেন। পার্কিংয়ে গাড়িপ্রতি ৩শ টাকা রাখার নিয়ম থাকলেও নিয়ম বহির্ভূতভাবে ৪শ টাকা করে নেওয়া হচ্ছে। বেশি টাকা নেওয়ায় প্রতিবাদ করলে ইজারাদার কৃষ্ণ চন্দ্র সাহাসহ তার লোকজন দুর্ব্যবহার করেন। এ ঘটনায় তিনি সোনারগাঁ থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন।

সরকার কর্তৃক নির্ধারিত ৩০০ টাকার পরিবর্তে কার পার্কিংয়ে রশিদ ছাপিয়ে আদায় করা হচ্ছে ৪০০ টাকা।

তবে অভিযুক্ত ১২ জনের সিন্ডিকেটের প্রধান নুরে আলম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, অতিরিক্ত টাকা কারো কাছ থেকে আদায় করা হয়নি। তাছাড়া কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পার্কিং, নৌকা ও মৌসুমী ফল বিভিন্ন সময় নিয়মতান্ত্রিকভাবে ইজারায় অংশগ্রহণ করে তা পেয়ে থাকি। আমরা কখনো কারো সঙ্গে প্রভাব খাটাইনি বা কারো সঙ্গে দুর্বব্যবহার করিনি।   

এ বিষয়ে সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম ভুঁইয়া বলেন, কেউ যদি দলের নাম ভাঙিয়ে কোনো অনিয়ম দুর্নীতি করে তার দায়ভার দল কখনো নেবে না।

ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক রবিউল ইসলাম বলেন, গাড়ি পার্কিং ও নৌকা ভ্রমণে অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিষয়ে অভিযোগ দিলে ইজারাদারদের বিরুদ্ধে ফাউন্ডেশন ব্যবস্থা নেবে।  

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪৭ ঘণ্টা, মার্চ ১৩, ২০১৯
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad