ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

চকবাজারে ট্র্যাজেডি: বাবাকে নিয়ে মেলায় যাবো!

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
চকবাজারে ট্র্যাজেডি: বাবাকে নিয়ে মেলায় যাবো! চকবাজারের আগুনে নিহত মোস্তফার স্ত্রী ও ‍দুই সন্তান

ঢাকা: পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন রিকশাচালক গোলাম মোস্তফা। সেদিন ঘটনাস্থলে ছিলেন এমন তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন গ্রামের বাড়ি থেকে দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন স্ত্রী জেসমিন বেগম।

ঢাকায় এসেই প্রথমে খোঁজ করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে। পরে আরো কয়েকটি হাসপাতালের মর্গ ঘুরে মরদেহ দেখে দেখেও স্বামী মোস্তফাকে খুঁজে পাননি জেসমিন।

পরবর্তীতে সিআইডির কাছে ডিএনএ স্যাম্পল দিয়ে নাজিমুদ্দিন রোডে বোনের বাসায় অপেক্ষা করতে থাকেন জেসমিন। অপেক্ষার প্রহর যেন আর ফুরায় না, এদিকে অবুঝ শিশুদের সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষাও খুঁজে পাচ্ছেন না।

অবশেষে মঙ্গলবার (১২ মার্চ) ডিএনএ স্যাম্পল প্রোফাইলিংয়ের মাধ্যমে রিকশাচালক মোস্তফার মরদেহ শনাক্ত করার কথা জানায় সিআইডি। সকাল বেলা জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ফোন মোস্তফার স্ত্রী জেসমিনকে বিষয়টি জানানো হয়।

খবর পেয়ে ঢামেক মর্গে আসার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন জেসমিন, ঠিক তখনই অবুঝ দুই শিশুর প্রশ্ন, ‘মা কোথায় যাচ্ছ?’ ক্রমেই নির্বাক হয়ে পড়া এই মায়ের উত্তর, ‘তোমাদের বাবাকে আনতে যাই’। এরপর দুই সন্তানও তাড়া দিতে থাকে মাকে—‘তাড়াতাড়ি চলো, বাবাকে নিয়ে বাড়িতে মেলায় যাব’।

মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেলে স্বামী মোস্তফার মরদেহ নিতে সন্তান জীবন (৭) ও জিসানকে (৬) নিয়ে ঢামেক মর্গের সামনে আসেন জেসমিন। বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে এসব কথা জানান তিনি।

নিহত রিকশাচালক মোস্তফার গ্রামের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জে। তিন ছেলেকে নিয়ে স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে থাকতেন আর ঢাকায় রিকশা চালাতেন মোস্তফা। থাকতেন লালবাগের একটি মেসে। মোস্তফাকে খুঁজতে দুই সন্তানকে নিয়ে ঢাকায় আসেন জেসমিন। বাড়িতেই স্বজনদের কাছে রেখে এসেছেন বড় ছেলে জিহাদকে (১২)।

আহাজারি করে জেসমিন বলেন, জীবন ও জিসান বার বারই জানতে চাচ্ছে, বাবা কই? তুমি বললা বাবাকে পাওয়া গেছে। তাড়াতাড়ি বাবাকে নিয়া বাড়ি চলো, বাবাকে নিয়ে মেলায় যাবো!

কথা বলতে গেলেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন জেসমিন। কান্না থামিয়ে আবার বলেন, “তাদের তো আর বলতে পারছি না, তোদের বাবাকে পাওয়া গেছে তবে জীবিত নাই। মারা যাওয়ারও ২০ দিন পর তোদের বাবাকে পাইছি!

সকালে ফোন পাওয়ার পর যখন আসার জন্য রেডি হচ্ছিলাম, তখনই তারা জানতে চায়, কোথায় যাব? তোদের বাবাকে পাওয়া গেছে, আনতে যাব বলার পর থেকেই তাড়া দিতে থাকে। আমি তো বলতে পারছি না, তোদের বাবা মারা গেছে!”

চকবাজারে আগুন লাগার সময় সেখান দিয়ে রিকশা চালিয়ে যাচ্ছিলেন মোস্তফা। খানিকটা দূরে থাকা আরেক রিকশাচালকের দেওয়া তথ্যেই দুই ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় ছুটে আসেন জেসমিন। কয়েকটি হাসপাতালের মর্গ ঘুরেও মরদেহ চিনতে না পারায় নিজের ও সন্তানদের ডিএনএ স্যাম্পল দিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন নাজিমুদ্দিন রোডের বোনের বাসায়।

তিনি জানান, ঘটনার দিন দুপুরবেলা মোস্তফা তাকে ফোন করেছিলো। ফোনে সন্তান ও বাড়ির খোঁজখবর নেন। ২২ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাড়ি যাবেন বলে জানিয়েছিলেন মোস্তফা। এটাই স্বামীর সঙ্গে শেষ কথা জেসমিনের।

সব প্রক্রিয়া শেষে মঙ্গলবার সন্ধ্যা নামতেই মোস্তফার মরদেহ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন জেসমিন। শেষ কথা হওয়ার ২০ দিনের ব্যবধানে স্বামীকে সঙ্গে নিয়েই বাড়ি ফিরছেন তিনি, তবে স্বামীর নিথর দেহ নিয়ে। জেসমিন কান্না করছেন আর তার দুই শিশু সন্তান অপলক তাকিয়ে থাকছে তার দিকে। পরক্ষণেই আবার বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আগ্রহ তাদের। তারাও বাবার সঙ্গে বাড়ি ফিরছে, তবে জানে না, বাবার হাত ধরে আর মেলায় যাওয়া হবে না তাদের!

বাংলাদেশ সময়: ১৯৪৯ ঘণ্টা, মার্চ ১২, ২০১৯
পিএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।