ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘মহাশিবরাত্রিতে চন্দ্রনাথধামে’

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০১৯
‘মহাশিবরাত্রিতে চন্দ্রনাথধামে’ চন্দ্রনাথে উঠার পথে তীর্থযাত্রীরা-ছবি-বাংলানিউজ

সীতাকুণ্ড (চট্টগ্রাম) থেকে ফিরে: আমাদের বাস যখন সীতাকুণ্ড বাজারে থামে তখন রাত ঠিক ২টা। দুলাল তালুকদার, তাপস দা, তন্ময় আর সজল মিলে আমাদের পাঁচজনের টিম। ফেনী থেকে ১ ঘণ্টারও কম সময়ে সীতাকুণ্ড বাজারে গিয়ে পৌঁছে আমাদের বাস। 

সীতাকুণ্ডে শিব চতুর্দশী মেলা রোববার (৩ মার্চ) শুরু হয়ে সোমবার (৪ মার্চ) দ্বিতীয়দিন মহাশিবরাত্রি। ধারণা ছিল মধ্যরাতে একটু নিরিবিলিভাবে পুরো এলাকা ঘুরে দেখা যাবে, স্বস্তিতে চন্দ্রনাথ মন্দিরে আরোহন করা যাবে।

কিন্তু ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে সীতাকুণ্ড বাজারে নামতেই আমাদের ধারণার ঠিক উল্টো চিত্র দেখা গেল। মধ্যরাতেও লাখও পূণ্যার্থীর সরব উপস্থিতি পুরো এলাকাজুড়ে। চন্দ্রনাথধামের মূল ফটক থেকে এখনও দূরত্ব প্রায় দুই কিলোমিটার।  

ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। ক্রমেই জনস্রোত মিশে যাচ্ছে তীর্থযাত্রায়। মাঝরাতেও পুরোপুরি জমজমাট মেলা। আসছে ঢাক-ঢোলের বাদ্য। পথে পথে ভক্তদের কেউ কিনছেন চিনি বাতাসা, কেউবা আবার কিনছেন মা-বৌদির জন্য সিঁদুর। আমাদের টিমে থাকা সজল জানালেন, এখান থেকে সিঁদুর কিনে নেওয়ার আলাদা একটা বিশেষত্ব আছে, তাই কম-বেশি সবাই চন্দ্রনাথে শিবচতুর্দশী মেলায় আসলে সিঁদুর কিনে নিয়ে যান।  
  
কিছুদূর যেতেই হাতের বামে পড়লো শংকর মঠ, তার বিপরীত দিকে ব্যাসকুণ্ড। সেখানে গিয়ে দেখা গেল পূণ্যার্থীরা নিজেকে শুদ্ধ করার জন্য স্নান করছেন। স্নানের পর পাশের ভৈরব মন্দির দর্শন করে পূণ্যার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছেন পাহাড় চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরের উদ্দেশে। যাওয়ার পথে হাতের বাম পাশে পড়লো কৃষ্ণ মন্দির, মহাশ্মশান।  

শিবের সাজে শিশুরা-ছবি-বাংলানিউজএ মেলায় না এলে শ্মশানেও যে এতো লোকের সমাগম হয়, তা হয়তো কেউ আঁচও করতে পারবেন না। একজন জানালেন তাদের স্বজনদের স্মরণ করতেই এখানে আসা।  

শ্মশান পার হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো হনুমান মন্দির, সীতা মন্দির ও গয়াকুণ্ড। আরও চোখে পড়লো সীতাকুণ্ড জনপদটি যার নামে সেই ‘সীতার কুণ্ড’। একজন পূণ্যার্থী জানান, এখান দিয়েই সীতা পাতালে যান।  

আমরা হাঁটছিলাম-কিছুদূর যাওয়ার পর চোখে পড়লো গয়াকুণ্ড, ভবানী মন্দির এবং তীর্থের অধিশ্বর শয়ম্ভুনাথ মন্দির। শয়ম্ভুনাথে আছে শিবলিঙ্গ। সেখানে পূণ্যার্থীরা শিবকে দুধ ও ডাবের জলে স্নান করানোর পাশাপাশি ফুল, বেলপাতা, ধুপকাঠি ও মোমবাতি দিয়ে পূজা করছেন। এরপরেই বীরুপাক্ষ চন্দ্রনাথের দুর্গম পথের মূল যাত্রা শুরু। বৃষ্টিস্নাত রাত, পাহাড়ের এবড়োথেবড়ো পথ তীর্থযাত্রাকে করে দিয়েছে আরও কঠিন। প্রচণ্ড ভিড় ঠেলে কপালের ঘাম ঝরিয়েই পূণ্যার্থীরা এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের লক্ষ্যে। পথেই মুগ্ধ করছিল দৃষ্টিনন্দন প্রাকৃতিক ঝর্না।

অনেকে মিটিয়ে নিচ্ছেন তৃষ্ণাও। এরপর আরও বেশ পথ হাঁটার পরেই বীরুপাক্ষ মন্দির। সেখানে জিরিয়ে নিচ্ছেন্ন পূণ্যার্থীরা। এখানেও রয়েছে শিবলিঙ্গ।

মন্দিরের পথে পূণ্যার্থীরা-ছবি-বাংলানিউজপূজা করার পরে গন্তব্য পাহাড় চূড়ার চন্দ্রনাথ মন্দির। একদিকে বৃষ্টি অন্যদিকে মানুষের ভিড় অন্ধকারে টর্চ-মোমবাতি হাতে চন্দ্রনাথের উদ্দেশে এগিয়ে যাচ্ছেন ভক্তরা। পথে পড়ে পাতাল কালী মন্দিরের রাস্তা। বেশ কিছুটা নিচে যেতে হয় এ মন্দিরে যেতে হলে। সেখান থেকে ফিরে আরও কিছুদূর পরে চোখে পড়ে পূণ্যার্থীর লক্ষ্যের সেই চন্দ্রনাথ মন্দির।  

চন্দ্রনাথ মন্দিরে গিয়ে পূণ্যার্থীদের চোখেমুখে প্রাপ্তির ছাপ। সে যেন এক অন্যরকম অনুভূতি। চন্দ্রনাথে যারা ব্রত করে গিয়েছেন তারা শিবলিঙ্গকে দুধ ও ডাবের জল, ফুল ও বেলপাতা দিয়ে পূজার্চনা সেরে ফেরার প্রস্তুতি নেন। প্রায় ২ ঘণ্টার ফেরার পথ পাড়ি দিয়ে শয়ম্ভুনাথ মন্দিরের পাশেই রয়েছে মহাপ্রসাদ আস্বাদনের আয়োজন।  

পূণ্যার্থীদের মধ্যে ভোলা জেলা থেকে আসা মনি রানী জানান, চন্দ্রনাথে উঠতে পূণ্যার্থীদের অনেক কষ্ট করতে হয়। রাস্তা ভীষণ খারাপ। কুমিল্লা থেকে আসা জয়দেব বলেন, এখানে পথে আলোর স্বল্পতা রয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ নিরাপত্তা এবং স্বেচ্ছাসেবকও নেই।  

পূণ্যস্নানে ব্যস্ত তীর্থযাত্রীরা-ছবি-বাংলানিউজফেরার পথে চোখে পড়ে সীতাকুণ্ড মেলা কমিটির অস্থায়ী কার্যালয়। সেখানে গিয়ে কথা হয় মেলা কমিটির অর্থ সম্পাদক তাপস চক্রবর্তীর সঙ্গে। চার দিনব্যাপী শিব চতুর্দশী মেলায় প্রায় ২০ লাখ পূণ্যার্থীর আগমন ঘটে। নিরাপত্তার জন্য প্রায় ৫শ’ পুলিশ-আনসার মোতায়েন রয়েছে। এছাড়াও মেলা কমিটির প্রায় আরও ১ হাজার স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে।  

মহাশিবরাত্রি
মহাশিবরাত্রি বা শিবরাত্রি হচ্ছে হিন্দু শৈব সম্প্রদায়ের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান। এই মহাশিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথিতে পালিত হয়। মহাশিবরাত্রি হলো সনাতন ধর্মের সর্বোচ্চ আরাধ্য দেবাদিদেব মহাদেব ‘শিবের মহারাত্রি’। অন্ধকার আর অজ্ঞতা দূর করার জন্য এই ব্রত পালিত হয়। অগণিত ভক্ত এদিন গঙ্গাজল, দুধ, বেলপাতা ও ফুল দিয়ে শিবের পূজা করেন।  

পূজা করছেন পূণ্যার্থীরাশিবমহাপুরাণ অনুসারে, অতি প্রাচীনকালে বারাণসী তথা কাশীধামে এক নিষ্ঠুর ব্যাধ বাস করতেন। তিনি প্রচুর জীবহত্যা করতেন। একদিন শিকারে বেরিয়ে খুব দেরি হওয়ায় তিনি জঙ্গলে পথ হারিয়ে রাতে হিংস্র জন্তুর ভয়ে এক গাছের উপর আশ্রয় নেন। কোনো শিকার না পেয়ে হতাশ হয়ে গাছ থেকে একটা করে পাতা ছিঁড়ে নিচে ফেলতে থাকেন। সেই গাছটি ছিল বেলগাছ। আর সেই বেলগাছের নিচে একটি শিবলিঙ্গ ছিল। সেদিন ছিল শিবচতুর্দশী অর্থাৎ মহাশিবরাত্রি। আর ব্যাধও ছিলেন উপবাসী। তার ফেলা বেলপাতাগুলো শিবলিঙ্গের মাথায় পড়ে। এর ফলে তার শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ হয় তার অজান্তেই। পরদিন ব্যাধ বাড়ি ফিরে এলে তার খাবার তিনি এক অতিথিকে দিয়ে দেন। এতে তার ব্রতের পারণ ফল লাভ হয়।

এর কিছুদিন পরে সেই ব্যাধ মারা গেলে যমদূতরা তাকে নিতে আসেন। কিন্তু শিবচতুর্দশী ব্রতের ফল লাভ করায় শিবদূতরা এসে যুদ্ধ করে যমদূতদের হারিয়ে ব্যাধকে নিয়ে যান। যমরাজ তখন স্বীকার করেন যে, শিবচতুর্দশী ব্রত পালন করে এবং শিব বা বিষ্ণুর ভক্ত যেই জন, তার উপর যমের কোনো অধিকার থাকে না। তিনি মুক্তিলাভ করেন। এভাবে মর্ত্যলোকে শিবচতুর্দশী ব্রতের প্রচার ঘটে।  

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০১৯
এসএইচডি/আরআর 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।