ঢাকা, বুধবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

একুশের ইতিকথা

জব্বারের রক্তে উত্তাল ময়মনসিংহ

এম আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯
জব্বারের রক্তে উত্তাল ময়মনসিংহ বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী ছবি

অগ্নিঝরা ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উত্তাল ঢাকা। রক্তাক্ত রাজপথ। প্রতিবাদ আর দ্রোহের আগুনে উত্তপ্ত সারাদেশ। শিক্ষা ও সংস্কৃতির শহর ময়মনসিংহেও ওঠে ভাষা আন্দোলনের ঝড়।
সেই সময়কার ঘটনা প্রবাহ নিয়ে ৪ পর্বের একটি ধারাবাহিক প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বাংলানিউজের সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট এম. আব্দুল্লাহ আল মামুন খান। পড়ুন প্রতিবেদনটির প্রথম কিস্তি।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে উত্তাল দেশ।

মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বে প্রথম রক্তদান করলো বাঙালি জাতি। আর সেই থেকে রক্তঝরা একুশে ফেব্রুয়ারি মানবজাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলো।

ভাষা শহীদদের একজন আব্দুল জব্বার। যাকে নিয়ে ময়মনসিংহের গর্ব। গফরগাঁও জেলার পাচুয়া গ্রামের কৃতি সন্তান। পাচুয়া এখন জব্বারনগর।

রাজনীতি সচেতন, শিক্ষা ও সংস্কৃতির জনপদ ময়মনসিংহ। ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে শুরু করে সব আন্দোলন-সংগ্রামে ময়মনসিংহ বরাবরই ছিলো অগ্রণী ভূমিকায়।

টংক আন্দোলন, হাতিখেদা আন্দোলন, মনা পাগলা বিদ্রোহ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই জনপদে স্বাভাবিকভাবেই ভাষা আন্দোলনের উচ্ছ্বাস আছড়ে পড়েছিলো তীব্রভাবে।

ভাষা আন্দোলনে ময়মনসিংহের ইতিকথা নিয়ে বিভিন্নজনের স্মৃতিচারণা, নিবন্ধে ও গবেষণায় বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। সেইসব সূত্রে জানা যায়, বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারির গুলির খবর সেদিনই ময়মনসিংহে পৌঁছে। মিছিলে গুলির ঘটনা, গুলিতে হতাহতের খবর টেলিফোনের মাধ্যমে ময়মনসিংহে আসে।

রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ময়মনসিংহের শিক্ষার্থীরা। ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচি জেলা পর্যায়ের ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমেও অনুসরণ হচ্ছিলো। বিভিন্ন সময়ে ধর্মঘট, সভা-সমাবেশ, বিক্ষোভ মিছিল কর্মসূচি যুগপৎভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছিলো রাজধানীসহ আঞ্চলিক পর্যায়েও।  

ময়মনসিংহে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়াও সাধারণ মানুষ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ আন্দোলনে সক্রিয় সমর্থন ব্যক্ত করেছিলো। ছাত্রদের আন্দোলন হলেও আপমর জনতা ছিলো উদ্দীপ্ত। আন্দোলনের খবরাখবর সম্পর্কে শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই ছিলো মানুষের আগ্রহ। ফলে একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাযজ্ঞের খবর মুহূর্তেই সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে।  

একুশে ফেব্রুয়ারির বিকেলেই ময়মনসিংহে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। স্টেশন চত্বর থেকে তাৎক্ষণিক মিছিল বের হয়। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতিতে ছিলো। পুলিশও হয় তৎপর।  

একুশে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যার পর ময়মনসিংহের নেতা-কর্মীরা রফিক উদ্দিন ভূইয়ার বাসভবনে সমবেত হন। আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়।  

পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে স্থানীয় টাউন হল চত্বরে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকায় পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ওই সভায় বিপুল সংখ্যক ছাত্র-জনতা যোগ দেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারীও সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভায় ভাষা আন্দোলনে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে ১ মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

সভায় সভাপতিত্ব করেন রফিক উদ্দিন ভূইয়া। বক্তব্য রাখেন সৈয়দ সুলতান আহমদ, আলতাফ উদ্দিন তালুকদার, ছাত্রনেতা এম শামসুল হক প্রমুখ। সভায় ময়মনসিংহ জেলা সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।  

২৫৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি হন আনন্দমোহন কলেজের শিক্ষক, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন। আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন রফিক উদ্দিন ভূইয়া।  

পরিষদ প্রথম কর্মসূচি নেয় পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি বৃহত্তর ময়মনসিংহে সাধারণ ধর্মঘট করার। ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন ময়মনসিংহ ছিলো বিক্ষোভে উত্তাল।  

এর আগেই ২২ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে প্রকম্পিত হয়। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ করে রাজপথে নেমে আসেন। মিছিলকে বাধা দিতে পুলিশ অ্যাকশনে নামে।

ওই সময় মেছুয়া বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাসমত আলী বেপারীর নেতৃত্বে ব্যবসায়ীরা দোকানপাট বন্ধ রেখে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেন। পুলিশের লাঠিচার্জে অনেকে আহত হন। পুলিশ প্রায় ৫০ জনকে আটক করে। গ্রেফতার হন ব্যবসায়ী নেতা হাসমত আলী বেপারী। তিনি ৬ মাস কারান্তরীণ ছিলেন।  

ময়মনসিংহে তিনিই প্রথম গ্রেফতার হন। ২২ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচিতে ময়মনসিংহে ছাত্র-জনতা স্বতঃস্ফূর্ত অংশ নেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহতদের মধ্যে ময়মনসিংহের আব্দুল জব্বারও রয়েছেন, এই খবরে ময়মনসিংহের রাজপথ উত্তাল হয়ে ওঠে।  

শুধু ময়মনসিংহ নয় গফরগাঁওয়ে বিক্ষোভ কর্মসূচি চলে। বিক্ষুব্ধ জনতা কাওরাইদ রেলস্টেশনে ট্রেন অবরোধ করে। গ্রেফতার হন ৬ জন ভাষা সৈনিক। ময়মনসিংহে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে ২৩ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহ অঞ্চলজুড়ে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়।

অফিস-আদালত, দোকানপাট, রাস্তাঘাটে বন্ধ পালিত হয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ধর্মঘটে বিক্ষোভে অংশ নেয়। ছাত্র-জনতা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভাষা আন্দোলনে অংশ নেন। শহরের বিপিন পার্ক ও রেলওয়ে স্টেশন চত্বরে সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে প্রথম বিক্ষোভ মিছিল হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ০৫১০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৯ 
এমএএএম/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।