ঢাকা, শনিবার, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ইয়োগেন হত্যার আড়ালে সবিতার স্বার্থের দ্বন্দ্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯
ইয়োগেন হত্যার আড়ালে সবিতার স্বার্থের দ্বন্দ্ব ইয়োগেন ও সবিতা

ঢাকা: কথা ছিল সখিনা বেগম সবিতা (২৬) ও নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইয়োগেন গোনসালভেজ দুজনে সমান-সমান বাসা ভাড়া দিয়ে একসঙ্গে থাকবেন রাজধানীর সবুজবাগের একটি বাসায়। ভাড়াও নেওয়া হয় কিন্তু শেষ পর্যন্ত থাকা হলো না ইয়োগেন গোনসালভেজের। সম্পর্কে বড় বোনের মতো দেখলেও তার (সবিতার) হাতেই রহস্যজনকভাবে নির্মমভাবে প্রাণ যায় ইয়োগেনের।

গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে সবুজবাগ থানা পুলিশ খবর পেয়ে ইয়োগেনের হাত-পা বাধা মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠায়।

ওইদিন সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কুদ্দুস ফকির বাংলানিউজকে বলেন, তার কাঁধে ও পিঠে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে।

প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি, কেউ উপর্যুপরি আঘাত করেছে।

ঘটনার পর হত্যার প্রকৃত রহস্য উদঘাটনে মাঠে নামে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও গোয়েন্দারা। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) রাত ১১টায় উত্তর মুগদার বান্ধবীর বাসা থেকে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও হত্যাকারী সবিতাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইয়োগেনকে হত্যার পরিকল্পনা ও দায় স্বীকার করেন সবিতা।

র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এমরানুল হাসান রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।

ইয়োগেনের সঙ্গে ২০১৩ সালে সবিতার প্রথম পরিচয় হয়। ২০১৭ সালের দিকে ইয়োগেন নটরডেম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার জন্ম নেয়। অন্যদিকে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়াশোনার সুবাদে সবিতার পরিচয় হয় জাফর উল্ল্যাহ রাসেল (৩৩) নামের আরেকজনের সঙ্গে। পিপলস হেল্প ফাউন্ডেশন (পিপিএইচএফ) নামের স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন ইয়োগেন, জাফর ও সবিতা।  

মাদক সেবনের টাকা চাওয়া নিয়ে ইয়োগেনের সঙ্গে সবিতার মনোমালিন্যের সূত্রপাত হয়।

জাফর আইনজীবী হিসেবে জজ কোর্টে কাজ করতেন। সবিতা কাজ করতেন শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসেবে, পাশাপাশি পড়াতেন একটি কোচিং সেন্টারে। ইয়োগেনকে প্ররোচিত বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী হিসেবে ব্যবহার করতেন জাফর ও সবিতা। পোর পিপলস হেল্প ফাউন্ডেশন আজীবন রক্তদাতা হিসেবে এরইমধ্যে সদস্য হোন সবিতা। ইয়োগেন এই প্রতিষ্ঠানের জাফরের সঙ্গে কাজ করতেন। ইয়োগেন নানা সময় জাফরের কাজে মামলার স্বাক্ষী হওয়ার কারণে সবিতার কাছে টাকা দাবি করতেন এবং টাকা না দিলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন।  

দিনের পর দিন মাদক সেবনের জন্য যখন-তখন টাকা চাইতেন ইয়োগেন। র‍্যাব সূত্রে জানা গেছে, জাফর ও ইয়োগেনের মধ্যে মতপার্থক্য থাকার পরেও বিভিন্ন মামলায় সাক্ষী দেন তিনি।  

নতুন ভাড়া বাসায় শেষ দ্বন্দ্ব
ইয়োগেন সাবিতাকে অনুরোধ করেছিলেন নতুন পৃথক বাসাভাড়া নিতে। যাতে চট্টগ্রামের তার পরিবার ঝামেলায় না পড়ে। পৃথক বাসা ভাড়া নিলে অর্ধেক ভাড়া ইয়োগেনকে বহন করতে হবে কারণ জাফরের সঙ্গে তার স্বার্থ জড়িত জানিয়েছিলেন সবিতা। জানুয়ারি মাসে ৫ হাজার টাকা অগ্রিম ভাড়া দিয়ে সবুজবাগে বাসা বুকিং দেন সবিতা। ফেব্রুয়ারি মাসে ভাড়া বাবদ ৮ হাজার টাকা অগ্রিম দাবি করেন ইয়োগেন। এছাড়াও মোবাইল বিল ও নেশার জন্য দিনে ২/৩ বার টাকা চাইতেন ইয়োগেন। পরবর্তীতে সবিতা চরম বিরক্ত হয়ে তাকে খুনের পরিকল্পনা করেন।

চেতনানাশক পান করিয়ে, বটি দিয়ে কুপিয়ে খুন
সবিতা ৫ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকা থেকে কালো ও সবুজ রঙের একটি ব্যাগ কেনেন, সঙ্গে ৬৫০ টাকা দিয়ে বটি কিনে হত্যার সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

১২ ফেব্রুয়ারি সবিতা ইয়োগেনের সঙ্গে কোর্টে দেখা করতে রাজি হন। ইয়োগেনকে তার ভাড়া করা বাসায় যাওয়ার কথা বলে সবিতা তার মোবাইল বন্ধ করে দেন এবং বেলা সাড়ে ৩টায় সবুজবাগের হিরাঝিল গলির মাথায় অপেক্ষা করতে বলেন।

মুগদা হাসপাতালের টয়লেটে গিয়ে বোরখা পরিধান করে গলির মাথায় ইয়োগেনসহ সবুজবাগে প্রবেশ করেন সবিতা।

সিসিটিভি ক্যামেরায় ইয়োগেন এবং সবিতা তার বাসায় প্রবেশ করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। ইয়োগেন তৃষ্ণার্ত অনুভব করায় জুস কিনতে বাইরে যান। এরই ফাঁকে সবিতা তার সঙ্গে আনা লাচ্ছির সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মেশান। ইয়োগেন বাসায় ফিরলে ওয়ানটাইম গ্লাসে করে লাচ্ছি খেতে দেন এবং সব দৃশ্য ইয়োগেনের মোবাইলে রেকর্ড করে পরে অন্য মোবাইল দিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে চারটি ভিডিও আপলোড করেন এবং মোবাইল থেকে ভিডিওগুলো ডিলিট করে দেন।

চেতনানাশক মেশানো লাচ্ছি খেয়ে ইয়োগেন কিছুক্ষণের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়লে হাত-পা-মুখ কাপড় দিয়ে বেঁধে এরপর বটি দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন ইয়োগেনকে। এক পর্যায়ে তিনি সালোয়ার কামিজ, ওড়না পড়ে খালি পায়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। ভুলে রেখে যান তার স্যান্ডেল যা পরবর্তীতে আলামত হিসেবে উদ্ধার করে র‍্যাব। বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা ভাড়া করে সবুজবাগ বালুর মাঠ দিয়ে মগবাজার বান্ধবীর বাসায় চলে যান। এরপর সবিতা বন্ধ করা মোবাইল চালু করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে মন্তব্য করতে চাই না। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে বিস্তারিত জানা যাবে। জাফর চরিত্রটি যথেষ্ট সন্দেহজনক মনে হয়েছে আমাদের কাছে। তাদের সংগঠন ও কাজের ধরন নিয়ে ভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া গিয়েছে। সেসব বিশ্লেষণের পর হত্যাকাণ্ডের পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।

সবুজবাগ থানায় এ বিষয়ে মামলা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছেন সবুজবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কুদ্দুস ফকির।

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯
ডিএসএস/আরআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।