ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

শহীদ জোহা দিবস

উপেক্ষিত ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৩৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯
উপেক্ষিত ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি শামসুজ্জোহা

রাজশাহী: ‘ডোন্ট ফায়ার! আই সেইড, ডোন্ট ফারায়! কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে যেন আমার গায়ে গুলি লাগে।’ ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের বাঁচাতে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে বলিষ্ঠ কণ্ঠে এমনই উচ্চারণ করেছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) তৎকালীন প্রক্টর ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা। সত্যিই সেদিন ছাত্রদের গায়ে গুলি লাগার আগে ঝাঁঝরা হয়েছিল তার বুক।

ড. জোহার রক্ত ঝরার মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। পতন ঘটে সামরিক জান্তা আইয়ুব খানের।

দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও বেশি ভিত্তি দেয় ড. জোহার আত্মত্যাগ।

গণআন্দোলনে বিজয় এসেছিল বাঙালির। ফলে মুক্তিযুদ্ধে প্রথম শহীদ বুদ্ধিজীবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় ড. জোহাকে। সেই দ্রোহী জোহার শাহাদতের দিনটিকে দীর্ঘদিন ধরে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘোষণার দাবি জানিয়ে আসছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও রাবি প্রশাসন। কিন্তু ৫০ বছরেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ‘জোহা দিবস’ হিসেবে দিনটি শুধু রাবিতেই পালিত হয়।

দেশে বছরে অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন করা হলেও এ দিবসটি জাতীয়ভাবে পালন করা হয়নি আজও! অথচ দিনটিকে ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ হিসেবে পালন করার সরকারি ঘোষণার জন্য দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছে রাবি প্রশাসন ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। কিন্তু তা আজও উপেক্ষিত।

...বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মো. আমজাদ হোসেন বলেন, ‘৫০ বছরেও দিবসটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস করা সম্ভব হয়নি। এটা অত্যন্ত হতাশাজনক। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালন করা এখন সময়ের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানিয়ে আসছেন। কিন্তু আজও ঘোষণা আসেনি'।

সেদিন যা ঘটেছিল
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি এবং সার্জেন্ট জহুরুল হক হত্যার প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-মিছিল বের করে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে পাকিস্তানি সেনারা মিছিলে গুলি করতে উদ্যত হয়। খবর পেয়ে তৎকালীন রাবি প্রক্টর শামসুজ্জোহা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ছাত্রদের সামনে দাঁড়ান। এ সময় তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলি করতে নিষেধ করে বলেন, ‘কোনো ছাত্রের গায়ে গুলি লাগার আগে তা আমার গায়ে লাগবে'।

একপর্যায়ে তিনি ছাত্রদের ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে বেলা ১১টার দিকে ক্যাপ্টেন হাদী পিস্তল বের করে ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিবিদ্ধ ড. জোহাকে পরে রাজশাহী মিউনিসিপাল অফিসে নিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।

শহীদ শামসুজ্জোহাড. জোহার সংক্ষিপ্ত জীবনী
প্রজ্ঞাবান ও বিদ্বান ড. মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ১৯৩৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তিন ভাই-বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বাঁকুড়া জেলা স্কুলে তিনি লেখাপড়া শুরু করেন এবং ১৯৪৮ সালে এ স্কুল থেকে তিনি প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরে বাঁকুড়া ক্রিশ্চান কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়ন সম্মান শ্রেণিতে ভর্তি হন ড. শামসুজ্জোহা।

১৯৫০ সালের পর ড. জোহার পরিবার স্থায়ীভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। ১৯৫৩ সালে ড. জোহা দ্বিতীয় শ্রেণিতে সম্মান ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৪ সালে তিনি প্রথম শ্রেণিতে এমএসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান অর্ডিন্যান্স কারখানায় সহকারী কারখানা পরিচালক পদে শিক্ষানবিশ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৫৬ সালে বিস্ফোরক দ্রব্যের ওপর প্রশিক্ষণ লাভের জন্য তিনি ইংল্যান্ডে যান। সেখানে তিনি ইমপেরিয়াল কলেজ ও লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এআরসিএস ও বিএস স্পেসিয়াল ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। বিদেশ থেকে পিএইচডি ও ডিআইসি ডিগ্রি নিয়ে পুনরায় তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন। ড. জোহা শহীদ হওয়ার সময় স্ত্রী নিলুফা জোহা ও এক কন্যা সন্তান রেখে যান। দীর্ঘ দিন ধরে তারা আমেররিকায় বাস করেন। বর্তমানে তারা সেখানকার নাগরিক।

শহীদ শামসুজ্জোহা হল।  ছবি: বাংলানিউজজোহার স্মৃতি রক্ষার্থে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন স্থাপনা
ড. জোহার স্মৃতি রক্ষার্থে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর চার টাকা মূল্যের ডাক টিকেট চালু করা হয়। রাবি ক্যাম্পাসে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয় তার নামে। শহীদ শামসুজ্জোহা হলের সামনে রয়েছে স্মৃতি ভাস্কর্য স্ফূলিঙ্গ। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করলে প্রশাসনিক ভবনের সামনে চোখে পড়বে জোহার সমাধি ও জোহা স্মৃতিফলক।

শাহাদত বার্ষিকীর আয়োজন
ড. জোহার শাহাদত বার্ষিকী উপলক্ষে সোমবার দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি নিয়েছে প্রশাসন। এর মধ্যে আছে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে কালো পতাকা উত্তোলন, সকাল পৌনে ৭টায় ড. জোহার মাজার ও স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ। এরপর বিভিন্ন বিভাগ, আবাসিক হল, স্কুল, পেশাজীবী সমিতি ও সংগঠনের পক্ষ থেকে শহীদ ড. জোহার মাজার ও জোহা স্মৃতিফলকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন।

সকাল ১০টায় শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ সিনেট ভবনে জোহা স্মারক বক্তৃতা। এতে বক্তব্য রাখবেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক শ্যামল চক্রবর্তী। বাদ জোহর রাবি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে কোরআনখানি ও বিশেষ মোনাজাত। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে দোয়া মাহফিল ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলন। এদিন শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শকদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৯
এসএস/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।