ঢাকা, শুক্রবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

দুদককে পথ দেখালো তারুণ্য

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯
দুদককে পথ দেখালো তারুণ্য দুদক কার্যালয়ে মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ইকবাল মাহমুদ। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: তারুণ্যই শক্তি, তারুণ্যই বল। তরুণরাই দেশের ভবিষ্যত। এই তরুণরাই দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়তে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) দেখালো দুর্নীতির রন্ধ্রের ঠিকানা। শেখালো দুর্নীতি প্রতিরোধের কৌশলও।

রোববার (১৭ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ‘দুর্নীতি দমন কমিশনের কৌশলপত্র-২০১৯’ এর উপর মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ অনুষ্ঠানে দেশের ৩০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থীরা এসব পথ বাতলে দেন।

এসময় তারা দুর্নীতির চেইন ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দুর্নীতি বিরোধী ক্লাব গড়ারও পরামর্শ দেন।

মতবিনিময় সভায় দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুদক  দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে বহুমাত্রিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আপনারা দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সবচেয়ে যোগ্য এবং মেধাবী সন্তান। তাই কমিশনের কর্মকৌশল প্রণয়নে সর্বপ্রথম আপনাদের সঙ্গেই আলোচনা করা হচ্ছে।  

‘আমরা আপনাদের কাছ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে নতুন ধারণা, সৃজনশীল আইডিয়া এবং সর্বোপরি কর্মপন্থা গ্রহণ করতে চাই। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রতিনিধি তথা বিশ্ববিদ্যাল শিক্ষার্থীদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণের এ জাতীয় মতবিনিময় সভা এটাই প্রথম। ’

দুদক চেয়ারম্যানের সূচনা বক্তব্যের পর গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রী তামান্না রিফাত আরা বলেন, দেশের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন কোনো পদ্ধতি নেই, যার সাহায্যে দুর্নীতি করার সুযোগ বন্ধ করা হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. সাইদুর রহমান বলেন, অপরাধীদের দ্রুত বিচার করা না গেলে অপরাধ দমন করা সম্ভব নয়। এসময় দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ারও সমালোচনা করেন তিনি।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মীরা রহমান বলেন, খাদ্যে ভেজালও দুর্নীতি। ছোট ছোট ব্যবসায়ীরা এ দুর্নীতি করছে এবং তারাই নিরাপদ খাদ্যের জন্য হুমকি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. ফারুক হোসেন বলেন, কৃষি ভর্তুকির অর্থ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পোঁছানোর আগেই বিভিন্ন স্তরে দুর্নীতি হয়। তাই এই বিষয়টি খতিয়ে দেখা উচিত।  

আর্মড ফোর্সেস মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী মো. আশিকুর রহমান মিয়া বলেন, আমরা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হচ্ছি কি-না এটি বড় প্রশ্ন।  

দুর্নীতিকে একটি চেইন অপরাধ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি  বলেন, নিচের দিকে কর্মরত কর্মকর্তারা জানেন তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও দুর্নীতিপরায়ণ। তাই দুর্নীতি করলে কিছু হবে না। আর এজন্য এসব অপকর্ম করে যান তারা।  

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী শম্পা গুহ বলেন, পদ্ধতিগত কারণেই দুর্নীতি অপ্রতিরোধ্য।  

‘আর স্কুল পর্যায়ে দুদক সততা সংঘ গঠন করলেও, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরনের কোনো সংগঠন নেই। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এথিকস ক্লাব গঠন করা যেতে পারে,’ বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শামস আসিফ চৌধুরী।  

দুর্নীতি বন্ধে উদ্যোগের বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অর্পিতা মহাজন বলেন, আইনি সংস্কার এবং প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ ও তাৎক্ষণিক ফল চাই।

দুর্নীতি বন্ধে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগের পরামর্শ দিয়ে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী টোটন  চন্দ্র দেবনাথ বলেন, দুর্নীতি যারা করেন তাদের ভয় ও লজ্জার ব্যবস্থা করতে হবে।  

অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থী ও গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, একসময় বলা হতো অর্থই অনর্থের মূল। কিন্তু সবসময় অনর্থের মূল নয়। অনেক সময় অর্থই অর্থের মূল। অর্থ মানেই ক্ষমতা।  

‘অনেক সময় মানুষ অর্থের পেছনে ছুটে। এটাতে তারা এখন আর লজ্জা পায় না, তাই দুর্নীতিবাজদের লজ্জা ফিরিয়ে আনতে হলে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষা এবং মূল্যবোধ সম্পন্ন উন্নয়নের প্রয়োজন। ’ 

তিনি বলেন, দুদককে ভয় পায় না এমন লোক হয়তো সমাজে নেই। তবে ভয় দিয়ে সবকিছু জয় করা যায় না।  

তবে দুর্নীতিবাজদের হুঁশিয়ারি দিয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রাখা হবে এবং  লোভের  জিহ্বা কেটে ফেলা হবে। আপনার বলছেন- শাস্তি হয় না, তথ্যটি সঠিক নয়। এবারও দুর্নীতির ৬৩ শতাংশ মামলায় সাজা হয়েছে। আমরা হয়তো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় দুর্নীতি কমাতে পরিনি।  

‘এই ৬৩ শতাংশ সাজা কিন্তু এমনিতে হয়নি। এটি আমাদের সবার ঐকান্তিক চেষ্টার ফল। আমি আগেও বলেছি আজও বলছি কোনো একক প্রতিষ্ঠানের পক্ষে দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। দুর্নীতি দমনের সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন। ’

তিনি বলেন, সব দুর্নীতিই দুদকের ম্যান্ডেটভুক্ত নয়। দণ্ডবিধির কিছু ধারা এবং অবৈধ সম্পদ অর্জন দুদকের তফসিলভুক্ত। দুর্নীতির উৎস বন্ধেও সরকারের  কাছে সুপারিশ করার আইনি দায়িত্ব দুদকের রয়েছে। কমিশন স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ  বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি প্রতিরোধ এ জনহয়রানি রোধে বিভিন্ন সুপারিশমালা সরকারের কাছে পাঠানো অব্যাহত রয়েছে।  

‘রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। আর বিষয়টি অনুধাবন করেই রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতি দমনের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বেড়েছে। একদিন বা এক বছরেই দুর্নীতি থেকে পরিত্রাণের উপায় নেই। ’

দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এটি একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় দুর্নীতি অবশ্যই সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে। দুর্নীতি দমন ও প্রতিরোধে শিক্ষাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৭৫ শতাংশ ফেল করা শিক্ষার্থীদের প্রমোশন দিয়ে মানসম্মত শিক্ষাকে কলুষিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশকে ২০৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে নেতৃত্ব দিতে এবং ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড পেতে হলে মানসম্মত শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই, এটা আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে।  

এ সময় দুদক কমিশনার এ এফ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, দুর্নীতি দু’টি পর্যায়ে বেশি হয়। একটি প্রাতিষ্ঠানিক এবং অপরটি ব্যক্তি পর্যায়ে। প্রাতিষ্ঠানিক মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে দুর্নীতি অবশ্যই কমে আসবে। হাসপাতালে পর্যাপ্ত ওষুধ রয়েছে। কিন্তু রোগীদের দেওয়া হচ্ছে না, শুধুমাত্র মনিটরিংয়ের অভাবেই রোগীর কাছে ওষুধ পৌঁছাচ্ছে না।

শিক্ষার্থীদের বক্তব্যকে আদর্শিক উল্লেখ করে দুদক কমিশনার ড. মো. মোজাম্মেল হক খান বলেন, তারা আদর্শিক অবস্থানে রয়েছেন। সুনীতি, সদাচার এবং দেশপ্রেমই তাদের আদর্শ। তাদের কোনো ব্যক্তি স্বার্থ কিংবা গোষ্ঠী স্বার্থ নেই। পদ্ধতিগত সংস্কারের কার্যক্রম চলমান। সিটিজেন চার্টার, ই-টেন্ডারিং পদ্ধতি, ক্রয় নীতিমালা সবই পদ্ধতিগত সংস্কারের অংশ।

মতবিনিময় সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন দুদক মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) সারোয়ার মাহমুদ। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুদক সচিব মোহাম্মদ দিলোয়ার বখ্‌ত, মহাপরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ মুনীর চৌধুরী, মহাপরিচালক (তদন্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান প্রমুখ।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০১৯
আরএম/এমএ 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।