ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

আত্মসমর্পণ করছেন বদির ভাইসহ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী

সুনীল বড়ুয়া, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯
আত্মসমর্পণ করছেন বদির ভাইসহ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী প্রতীকী

কক্সবাজার:  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এবার আত্নসমর্পণ করতে যাচ্ছেন শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। এসব ব্যবসায়ীর মধ্যে শীর্ষ ২০ থেকে ৩০ জনসহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত রয়েছেন ৫৫ থেকে ৬০ জন। রয়েছেন বহুল আলোচিত সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদির ভাইসহ অন্তত ১০ জন নিকটাত্মীয়।

প্রায় মাস খানেক ধরে এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীরা পুলিশি হেফাজতে থাকার পর শনিবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবেন। আর বিষয়টি নিয়ে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের সাধারণ মানুষের মধ্যে কৌতুহলের শেষ নেই।

এদিকে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সফল করতে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে কক্সবাজার জেলা পুলিশ। অনুষ্ঠানস্থল টেকনাফ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে তৈরি করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। সার্বিক কাজ তদারকি করতে গত কয়েকদিন ধরে কক্সবাজার অবস্থান করছেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি খন্দকার গোলাম ফারুক।

জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে অনুষ্ঠেয় এ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল। এছাড়াও পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. মো. জাবেদ পাটোয়ারী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তফা কামাল উদ্দিন বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন শুক্রবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) বাংলানিউজকে বলেন, শনিবার শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী আত্মসমর্পণ করবেন। তবে এ সংখ্যা একটু কম বেশি হতে পারে। এদের মধ্যে চিহ্নিত এবং তালিকাভুক্ত ইয়াবা ব্যবসায়ী রয়েছেন অর্ধশতাধিক।

তিনি বলেন, আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সফল করতে এরইমধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা সম্পন্ন করেছি। প্রস্তুতি কাজ তদারকির জন্য গত কয়েকদিন ধরে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি কক্সবাজার অবস্থান করছেন। আশা করছি পুলিশের এ উদ্যোগ মাদক নির্মূলে টেকনাফ তথা পুরো কক্সবাজার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।  
    
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আত্নসমর্পণের জন্য প্রায় একমাস আগে থেকে পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন এসব মাদক ব্যবসায়ীরা। এদের মধ্যে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদির ভাই আবদুর শুক্কুর, আবদুল আমিন, মো. শফিক, মো. ফয়সাল, বেয়াই শাহেদ কামাল, চাচাতো ভাই মো. আলম, ফুফাতো ভাই কামরুল ইসলাম, ভাগিনা সাহেদুর রহমান নিপু, খালাতো ভাই মং মং সিংসহ অন্তত দশজন নিকটাত্মীয় রয়েছেন।

এছাড়াও রয়েছেন টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমদের ছেলে দিদার মিয়া, ভাইয়ের ছেলে মো. সিরাজ, হ্নীলার ইউপি সদস্য জামাল হোসেন, নুরুল হুদা মেম্বার, তার ভাই নুরুল কবির, টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর নুরুল বশর নুরশাদ, নারী কাউন্সিলর কহিনুর বেগমের স্বামী শাহ আলম, টেকনাফ সদর ইউপি সদস্য এনামুল হক, ছৈয়দ হোসেন মেম্বার, ছৈয়দ আহমদ ছৈতু, শফিকুল ইসলাম, মো. ইউনুছ, একরাম হোসেন, রেজাউল করিম মেম্বার, মোজাম্মেল হক, জোবাইর হোসেন, মারুফ বিন খলিল ওরফে বাবু, মো. ইউনুছ, উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল্লাহর দুই ভাই জিয়াউর রহমান ও আবদুর রহমানসহ শতাধিক ইয়াবা ব্যবসায়ী। পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে, এসব ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ২ থেকে ১৫টি মামলা রয়েছে।

অন্যদিকে টেকনাফের বহুল আলোচিত ইয়াবা গডফাদার হাজি সাইফুল করিমকে নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন। অনেকে বলছেন সাইফুল করিমও শনিবার আত্নসমর্পণ করতে যাচ্ছেন। তবে পুলিশের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, সাইফুল পুলিশি হেফাজতে নেই। তবে এমপি বদির আরেক ভাই পৌর কাউন্সিলর মাওলানা মুজিবুর রহমানও আত্নসমর্পণ করতে পারেন বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে।

কক্সবাজার জেলা গোয়েন্দা পুলিশের সবশেষ ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা ব্যবসায়ী। তাদের ৬৬ জনই টেকনাফের বাসিন্দা।

গত বছরের ৪ মে থেকে দেশজুড়ে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এরপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সন্ত্রাসীদের মধ্যে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শুধু কক্সবাজার জেলায় ৪৪ মাদক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।  

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সবক’টি তালিকায় ‘পৃষ্ঠপোষক’ হিসেবে আবদুর রহমান বদি ও ইয়াবা গডফাদার হিসেবে তাঁর পাঁচ ভাই, এক বোনসহ ২৬ জন নিকটাত্নীয়ের নাম রয়েছে।

পুলিশ, বিজিবি, কোস্টগার্ড, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা অনুযায়ী সারাদেশে তিন হাজারেরও বেশি চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রয়েছেন। এদের মধ্যে কক্সবাজার জেলায় আছেন ১ হাজার ১৫১ জন। তারমধ্যে ৭৩ জন প্রভাবশালী ইয়াবা ব্যবসায়ীকে (গডফাদার) চিহ্নিত করা হয়েছে। যার বেশিরভাগই টেকনাফের।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ইকবাল হোসেন বাংলানিউজকে জানান, গত ৪ মে থেকে সারাদেশে আইন-শঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করা হয়। এরপর থেকে এ অভিযানে এবং মাদক ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শুধু কক্সবাজারেই কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অর্ধশতাধিক মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। এদের ৯০ ভাগই টেকনাফের।

তবে মাদকবিরোধী অভিযান অব্যাহত ও ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটলেও বন্ধ হয়নি ইয়াবা পাচার। প্রায় প্রতিদিনই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবা ধরা পড়ছে। গত দুইমাসে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, কোস্টগার্ড ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হাতে ধরা পড়েছে প্রায় ১৬ লাখ ইয়াবা।

সবকিছু মিলে আদৌ মাদক ব্যবসা নির্মূল করা যাবে কি-না বা কতটা ফলপ্রসূ হবে আত্মসমর্পণের এই উদ্যোগ, তা নিয়ে সচেতন মহলের সংশয় কাটছে না। তাদের দাবি, আত্মসমর্পণ করলেও এসব চিহ্নিত ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি যেন সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।

কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মো. আলী বাংলানিউজকে বলেন, মাদক তথা ইয়াবার কারণে আমাদের বিশেষ করে টেকনাফের মানুষের মাথানত হয়ে যাওয়ার অবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে মাদক ব্যবসায়ীদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসনীয় উদ্যোগ। তবে এ উদ্যোগকে কিভাবে আরো ফলপ্রসূ করা যায়, এর দায়িত্ব সরকার, পুলিশ বিভাগের। এরা যাতে আত্মসমর্পণের নামে পার পেয়ে না যায় সে বিষয়টিও তাদের দেখতে হবে। না হলে পরিস্থিতি হবে আরো ভয়াবহ।

কক্সবাজার পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, আত্মসমর্পণকারী ইয়াবা ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো আছে, সেসব মামলা আইনের গতিতে চলবে। তাদের যদি অবৈধ সম্পদ থাকে সে বিষয়টিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখবে। পার পেয়ে যাওয়ার মতো কোনো সুযোগ থাকবে না। এছাড়াও আরো অনেক সিদ্বান্তের বিষয় আছে, যেগুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নেবে। তিনি বলেন, মাদক বিশেষ করে ইয়াবা পাচারের কারণে সারাদেশে কক্সবাজারের যে দুর্নাম ছড়িয়েছে, সেই দুর্নাম ঘোচানোর জন্যই আমাদের এ উদ্যোগ। আশা করছি আমরা সফল হবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৯
এসবি/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।