ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

চলে গেলেন রাশেদ মোশাররফ

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিংএডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২৩০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১১
চলে গেলেন রাশেদ মোশাররফ

ঢাকা: বীর মুক্তিযোদ্ধা রাশেদ মোশাররফ চলে গেলেন। বৃহস্পতিবার ঢাকায় ৭৬ বছর বয়সে প্রাণবিয়োগ ঘটেছে চুপচাপ এই নরম স্বভাবের মানুষটির(ইন্নালিল্লাহি---রাজিউন)।



এর সঙ্গে সমাপ্তি ঘটেছে একটি অধ্যায়ের। তাকে আর কোনও দিন দেখা যাবে না রাজপথে জনতার মিছিলে, বঙ্গবন্ধু এভিন্যুর আওয়ামী লীগ অফিসে, অথবা ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বরে।

পঁচাত্তরের আগস্টে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নভেম্বরে এর বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিবাদ তথা অভ্যুত্থান গড়ে তুলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। তার ভাই রাশেদ মোশাররফ আর মা সেই অভ্যুত্থানের সমর্থনে মিছিল বের করলে সেনাবাহিনীর পাকিস্তানপন্থিরা ভারতীয়পন্থি আধিপ্যবাদের নাম দিয়ে-গুজব ছড়িয়ে খালেদ মোশাররফকে হত্যা করে। এরপর থেকে জনতার মিছিলেই ছিলেন রাশেদ মোশাররফ। বারবার নির্বাচিত হয়েছেন তার জামালপুরের আসনে।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে রাশেদ মোশাররফকে ভূমি প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেয়া হয়। ভূমি মন্ত্রণালয় বিটের রিপোর্টার হিসাবে সে সময় তার অনেক কিছু কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়।

আব্দুল হাই নামের একজন উপ-সচিব ছিলেন মন্ত্রণালয়ে। তরুণ টগবগে সৃষ্টি সুখের উল্লাসী। তাকে নিয়ে নানান কর্মযজ্ঞ তিনি সাজাতেন। ভাসানটেকে বস্তিবাসীদের জন্য ফ্লাটসহ আরও কত কী! তারা যা সবকিছু ঠিকঠাক করতেন আর আমলাতন্ত্র দিয়ে তা ঠেকিয়ে দিতেন জামায়াতপন্থী সচিব ওমর ফারুক!

এই সচিব সহ আমলাতন্ত্রের ভিতর ঘাঁপটি মেরে থাকা জামায়াতিদের দেখিয়ে প্রায় অসহায়ভাবে বলতেন দেশটা স্বাধীন করল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষেরা, এরপর সেটি স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতিদের হাতে বেদখল হয়ে গেল! এদের গায়ে হাত দিতে গেলেই তারা আবার প্রশাসনে নিরপেক্ষতার নামে শোরগোল তুলে।

২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় ফিরলে ওমর ফারুককে স্বরাষ্ট সচিব করা হয়। এখন দশ ট্রাক অস্ত্র চোরচালান থেকে শুরু করে নানাকিছুতে আসছে তার সংশ্লিষ্টতা!

দীর্ঘদিন কৃষক লীগের সভাপতি হিসাবে দেশের ভূমি সমস্যার নানান ধারাপাত তার মুখস্ত ছিল। এমনিতে বাংলাদেশের ভূমি ব্যবস্থাটি জটিল। দেশের খুনোখুনির ঘটনার বেশিরভাগ জমি সংক্রান্ত। আর বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিক রকমফেরে জমির মালিক ভূমি মন্ত্রণালয় হলেও এর দলিল করে আইন মন্ত্রণালয়ের অধীন সাবরেজিস্ট্রার অফিস। পরিসংখ্যান তৈরি করে আলাদা মন্ত্রণালয়! রাশেদ মোশাররফ এই তিনটি মন্ত্রণালয়ের অধীন উপজেলা ভূমি, তহশিল, সাবরেজিস্ট্রার অফিসকে একই কম্পাউন্ডে অথবা এক ছাতার নিচে আনতে চেষ্টা করে  পারেননি। এখন দলিল যেভাবে লেখা হয় তা সিংহভাগ মানুষ এর মাথামুন্ডু বোঝেন না। জমি জালিয়াতির একশ ফাঁকফোকর থাকে এসব দলিলের মধ্যে। জমির মালিকানা দলিলকে কম্পিউটারাইজড করতে তার উদ্যোগটি দলিল লেখকদের আন্দোলন-হুমকির মুখে পরিত্যক্ত হয়। দলিল লেখককে কম্পিউটার ব্যবহার শেখানো, তাদের দিয়ে দলিল কম্পিউটারাইজডের প্রতিশ্রুতি দিয়েও তাদের বশে আনা যায়নি।

দেশের হাওড় বাওর জলমহালগুলোও ভূমি মন্ত্রণালয়ের অধীনে। একবার সে সব সরেজমিন দেখতে সুনামগঞ্জ গেলে সঙ্গে নেয়া হয়। সুনামগঞ্জ শহর থেকে স্পীডবোর্ডে নদী-খাল পেরিয়ে হাওর রাজ্য দেখার সে অভিজ্ঞতা প্রথম।

জাল যার জলা তার নীতিতে সরকার কাগজে-কলমে এসব হাওড়বাওড় জেলে সম্প্রদায়ের কাছে ইজারা দেয়। আসলে কাগজেকলমে জেলেদের নিয়ে গড়া সমবায় সমিতির নাম ভাঙ্গিয়ে নেপথ্য এগুলো দখল-এনজয় করে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

জমির মালিকরা ল্যান্ড লর্ড। আর হাওড়বাওড়ের নেপথ্যের এসব মালিকেরা? সব পরিস্থিতি দেখেশুনে এদের নতুন একটি নাম-টার্ম চালু করতে ইচ্ছে করে।   লেখা হয়ে যায় ওয়াটার লর্ড! ঢাকায় ফিরে রিপোর্টের নানান প্রতিক্রিয়া দেখে রাশেদ মোশাররফ মন্তব্য করে বলেন, বাহ পানির জগতের মোড়ল-গডফাদারদের আপনার দেয়া নতুন নামটিত খেয়েছে বেশ! ওয়াটার লর্ড! এখনও অনেকের রিপোর্টে ওয়াটার লর্ড অভিধাটি দেখে রাশেদ মোশাররফকে মনে পড়ে খুব। বৃহস্পতিবার থেকে তিনি স্মৃতি!  শুধুই স্মৃতি!

নিউজে দেখলাম তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসাবে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু রাশেদ মোশাররফের মতো একজন নেতা কেন অপাংক্তেয় ছিলেন দীর্ঘদিন, তা কেউ জানল না। যে কেবিনেটে আবুল-শাহজাহান খান-রাজিউদ্দিন রাজুদের কদর, সেখানে রাশেদ মোশাররফদেরতো অপাংক্তেয় থাকারই কথা! হায় মুক্তিযুদ্ধের সরকার! কী খবর আব্দুর রাজ্জাক ভাইর? তার কথা পার্লামেন্টে তুলে কী বিপদেই না পড়লেন তোফায়েল আহমদ! এরা সবাই এভাবে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবেন। তৈরি শোকবাণীগুলো চলে আসবে মিডিয়ায়। জনতার প্রিয় রাশেদ মোশাররফ ভাইর আত্মার শান্তি কামনা করছি।

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক

বাংলাদেশ সময়: ২২৫৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।