তবে পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অতিরিক্ত ব্যয়ের জন্য বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান এবং জমির দাম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি হওয়াকে দায়ী করেছেন।
বাংলানিউজের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উন্নয়ন ব্যয় নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন পরিকল্পনা মন্ত্রী।
মুস্তফা কামাল বলেন, ভৌগলিক কারণে বাংলাদেশের যেখানে অবস্থান, সেখানে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে সড়ক ও রেলপথ তৈরির ক্ষেত্রে অন্য সবার চেয়ে বেশি টাকার প্রয়োজন হয়। শত শত নদী বেস্টিত ব-দ্বীপ আকৃতির পলিমাটির এ দেশের উপরে হিমালয় পর্বতমালা, গারো পাহাড়, আসাম ও মেঘালয়ের পাহাড় শেষ হয়েছে একেবারে বাংলাদেশের সীমান্তে এসে। দেশের নদীগুলোর উৎসও ভারত। উঁচু থেকে নেমে আসা নদীগুলো দেশে প্রবেশ করে আচরণও করে বিচিত্রতর। তাই আমাদের দেশে অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনাতে এসব বিষয় মাথায় রাখতে হয়।
পরিকল্পনা মন্ত্রী বলেন, ইউরোপ, আমেরিকা, চীন বা ভারতের ভূমির গঠন আর বাংলাদেশের ভূমির গঠন এক নয়। ওইসব দেশে সড়কপথ ও রেলপথ তৈরিতে তেমন কোন মাটি ভরাটের কাজ থাকে না। প্রয়োজন হয় না সয়েল টেস্ট ও সয়েল ট্রিটমেন্টের মতো ব্যয়বহুল কাজেরও। আমাদের দেশে রাস্তা তৈরি করতে সয়েল টেস্টের প্রয়োজন হয়, সয়েল ট্রিটন্টেরও প্রয়োজন হয়। এরপর ইট, বালু, পাথর দিয়ে ১৫ থেকে ৩০ ফুট পর্যন্ত ভূমি উঁচু করতে হয় ধাপে ধাপে। কোথাও কোথাও এক কিলোমিটারের মধ্যে ব্রিজ ও কালভার্ট তৈরি করতে হয় একাধিক। এসব খরচ অন্য কোন দেশে নেই। কোথাও রাস্তার উচ্চতাও গড়ে ১৫ ফুট উঁচু হয় না। আমাদের বেশিরভাগ সড়ক ও রেলপথই বন্যাপ্রবণ এলাকা, প্লাবন ভূমি ও বিলের মধ্য দিয়ে তৈরি। ফলে আমাদের স্থায়িত্বের কথা চিন্তা করতে হয়।
মুস্তফা কামাল বলেন, অন্যান্য দেশের চেয়ে আমাদের উন্নয়ন ও নির্মাণ ব্যয় এমনিতেই তিন/চারগুণ বেশি হওয়ার কথা কেবল আমাদের ভূমিগ্রহণ আইনের কারণে। বাংলাদেশের ভূমি অধিগ্রহণ খরচও অন্য যেকোন দেশ থেকে তিন/চারগুণ বেশি। এমনিতেই বিশ্বের যে কোন দেশের জমির দামের চেয়ে বাংলাদেশের জমির দাম বেশি। এরপর আবার সরকার বর্তমান বাজার দরের চারগুণ দর দিয়ে জমি অধিগ্রহণ করে থাকে। এটাও নির্মাণ ব্যয় বাড়ার অন্যতম কারণ।
পরিকল্পনামন্ত্রী মন্ত্রী বলেন, সিস্টেমলস যে নাই তা বলবো না। সেটা হয়তো ১০ থেকে ১৫ ভাগ থাকতে পারে। কিন্তু তার জন্য যে নির্মাণ ব্যয় চার/পাঁচ গুণ বাড়বে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত অনুসারে ২০১৫ সালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চার লেনের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে ব্যয় হয় ২৮ কোটি টাকা, ভারতে ১০ কোটি ও চীনে ১৩ কোটি টাকা। অন্যদিকে বাংলাদেশে এ খরচ গড়ে ৬০ কোটি টাকা। অন্যদিকে কেবল ঢাকা-মাওয়া সড়কের নির্মাণ পরিকল্পনা হয়েছিলো ৯৫ কোটি টাকা প্রতি কিলোমিটার হিসেবে। যা বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মহাসড়ক হিসেবে এরইমধ্যে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছে।
ইকোনমিক কমিশন ফর ইউরোপ (ইউএন-ইসিই) এর পরিসংখ্যান ও ন্যাশনাল টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি অব অ্যাথেন্সের অধ্যাপক দিমিত্রিয়স স্যামবুলাসের ‘এস্টিমেটিং অ্যান্ড বেঞ্চমার্কিং ট্রান্সপোর্ট ইনফ্রাস্ট্রাকচার কস্ট’ রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৫ সালে চার লেনের নতুন সড়ক নির্মাণে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ব্যয় হয় ৩৫ লাখ ডলার বা ২৮ কোটি টাকা। আর দুই লেন সড়ককে চার লেনে উন্নীত করতে খরচ হয় ২৫ লাখ ডলার বা ২০ কোটি টাকা।
সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্বের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর সড়ক নির্মাণ বিষয়ক রিপোর্টে দেখা যায়, প্রতি কিলোমিটার নতুন চার লেনের সড়ক নির্মাণে এসব দেশে ব্যয় হয় ২২ লাখ ডলার বা ১৭ কোটি টাকা। আর দুই লেন সড়ককে চার লেন করতে খরচ হয় ১৪ রাখ ডলার বা ১১ কোটি টাকা। ৪০টি দেশের পাওয়া তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে এ রিপোর্ট তৈরি করা হয়। ‘দ্য কস্ট অব রোড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইন লো অ্যান্ড মিডল ইনকাম কান্ট্রিস’ নামের ওই রিপোর্ট তৈরি করেন অক্সফোর্ড, কলম্বিয়া ও গোথেনবার্গ বিশ্ববিদালয়ের তিন অধ্যাপক।
এদিকে ভারতের ১২তম (২০১২-১৭) পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার রিপোর্ট অনুযায়ী সে দেশে প্রতি কিলোমিটার চার লেনের নতুন সড়ক নির্মাণে খরচ হয় ৮ থেকে ৯ কোটি রূপি। জমি অধিগ্রহণ খরচসহ যা বাংলাদেশি টাকায় ১০ কোটি টাকা। আবার দুই লেন সড়ক চার লেনে উন্নীত করতে সেখানে খরচ হয় বাংলাদেশি টাকায় ৬ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ সময়: ২০৩২ ঘণ্টা, জুলাই ১৮, ২০১৮
আরএম/এমজেএফ