ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

হারিয়ে যেতে বসেছে বেনারসি-কাতান 

মফিজুল সাদিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৮ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
হারিয়ে যেতে বসেছে বেনারসি-কাতান  শাড়ি বোনায় ব্যস্ত এক শ্রমিক। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: ঢাকা মিরপুর বেনারসিপল্লীর শ্রমিক মুন্না আশরাফ। কাজ করেন রফিক হ্যান্ডলুম তাঁতপল্লীতে। এই পল্লীতে বেনারসি ও কাতান শাড়ি বোনা হয়। 

প্রতিটা শাড়ি তৈরির মুজুরি ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা। একটা শাড়ি বুনতে সময় লাগে ৯ থেকে ১০ দিন।

তাঁত শ্রমিকের দৈনিক মজুরি পড়ে মাত্র ২০০ টাকা। ফলে অনেকেই ছেড়ে দিচ্ছেন তাঁত বুননের কাজ। এসব কাতান-বেনারসি শাড়ি মানভেদে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে।

মুন্না আশরাফ বলেন, একটি শাড়ির মুজুরি-খরচা দুই হাজার টাকা। দিনে মাত্র ২০০ টাকা মজুরিতে ১০দিন খেটে যে আয় হয়, তা দিয়ে সংসার চলে ‍না। পাড়া-মহল্লায় সবজি বিক্রি করলেও তো দিনে ৫০০ টাকা আয় করা যায়। তাই ভাবছি এবার ঈদের মৌসুমির পর আর তাঁতে কাজ করবো না। ’
 
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মিরপুর বেনারসিপল্লীতে কর্মচারী মিলছে না। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী হ্যান্ডলুম বা হস্তচালিত তাঁতশিল্প। কারণ কম আয় দিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে সুন্দরভাবে তো দূরের কথা কোনোমতে খেয়েপড়েও দিন গুজরান করতে পারছেন না শ্রমিকেরা।  

সময় যতই পার হচ্ছে ততই এ এলাকা থেকে তাঁতশিল্প বিলীন হয়ে যাচ্ছে। লোকসানে পড়ে  অনেকে বাপ-দাদার আদি পেশা ছেড়ে দিয়েছেন।  

মিরপুর বেনারসিপল্লীর শরিফুল ইসলামের চারটি তাঁত ছিলো। বর্তমানে বাপ-দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। এখন মাত্র একটি তাঁত অবশিষ্ট আছে তার। অন্যের জমিতে শেয়ারে তাঁতটি পরিচালন করতে হচ্ছে তাকে। .
 সূত্র জানায়, ১৯৮৬ সালে মিরপুর ১০, ১১ ও ১২ নম্বরে ৭ থেকে ৮ হাজার তাঁত ছিল।  তাঁতের ওপর নির্ভর করে অনেকের  জীবন-জীবিকার চাকা ঘুরতো। বর্তমানে যুগের আধুনিকায়ন, কাঁচামালের অভাব ও উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়া, শ্রমের সঠিক সঠিক মূল্য না পাওয়াসহ নানান কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে  তাঁতশিল্প। ভারতীয় পাওয়ার লুমের শাড়ির প্রভাবেই এখন তাঁতের সংখ্যা মাত্র ৭’শ থেকে ৮’শটিতে নেমে এসেছে। একটি পাওয়ার লুম দৈনিক ৭টা শাড়ি তৈরি করতে পারে। অথচ হ্যান্ডলুমে একটি শাড়ি তৈরিতে সময় লাগে ১০ দিন।
 
তাঁতপল্লীর একজন তাঁতমালিক মোহাম্মদ রফিক। বাংলানিউজকে তিনি বলেন, আমরা বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে দেব। বিদেশি শাড়ির প্রভাবে আমরা বেনারসি ও কাতান শাড়ির ন্যায্য দাম পাচ্ছি না। ফলে কারিগরদের সঠিক মুজুরিও দেয়া যাচ্ছে না।
 
নগরী থেকে বেনারশী-কাতান শাড়ী হারিয়ে যাওয়ার মূল কারণ জমির সমস্যা। তাঁতপল্লী তুলে দিয়ে জমিয়ে অন্যান্য ব্যবসা বাণিজ্য করা হচ্ছে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় জমির ব্যবস্থা না করলে নগরী থেকে একদিন তাঁতপল্লী একেবারেই হারিয়ে যাবে—এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। অথচ ঢাকাতেই এখনো সবচেয়ে উন্নত মানের বেনারসি ও কাতান শাড়ি তৈরি হয়। ‌
 
তাঁতীরা জানান, জমি দেয়ার নামে ২০০৩ সালে তাঁত মালিকদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নিয়েছিল বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড। অথচ দীর্ঘ ১৫ বছর পরও ভাসানটেকে তাঁতীদের জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। মিরপুরে ১ হাজার ৮৭৫ জন তাঁতীর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়।
 
এ প্রসঙ্গে ১০ হাজার টাকা জমা দেয়ার রশিদ দেখিয়ে আবুল কালাম বেনারসি বাংলানিউজকে বলেন, ২০০৩ সালে আমাদের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। কথা ছিলো ভাসানটেকে বিশাল তাঁতপল্লী হবে। সেখানে এক কাঠা জমি পাবো। এই জমিতে তাঁতপল্লী গড়বো। অথচ আমাদের জমি দেয়া হয়নি। জমি দেয়ার কথা বলে আজকে ১৫টি বছর ধরে আমাদের ঘোরানো হচ্ছে। জমি না পেলে আর তাঁতশিল্প গড়ে তোলা সম্ভব নয়। ’
 
বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড সূত্র জানায়, তাঁতপল্লীর জন্য ভাসানটেকে মোট জমির পরিমাণ ৩০ একর। ১ হাজার ৮৭৫ জনের মধ্য থেকে ৯০০ জনকে লটারির মাধ্যমে তিন শতক করে জমি দেয়ার কথা। কিন্তু মামলার জটিলতায়  তাঁত মালিকদের জমি বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে না। ভাসানটেকে তাঁতপল্লীও হচ্ছে না।
 
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ডের সদস্য মিজানুর রহমান বলেন, জমি দেয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম। কিন্তু একটা স্বার্থান্বেষী মহল মামলা ঠুকে দিয়েছে। কিছু বস্তিবাসীর জন্য বাড়ি নির্মাণ করেই তারা মামলা করে দেয়। এখনও মামলা নিষ্পত্তি হয়নি।  

অন্যদিকে তাঁতীদের পাওনা টাকা ফিরিয়ে দিলেও তাঁতীরা তা নিচ্ছে না। তারা তিনশতক করে জমি চায়। এখন আমরা কী করবো ভেবে পাচ্ছি না।
 
দেশব্যাপী নানা সমস্যায় জর্জরিত তাঁতশিল্প। ফলে শুধু ঢাকা নয়, সারাদেশেই ধুকেঁ মরছে ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প।
 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্র জানায়, ‘পরিসংখ্যান আইন ২০১৩’ অনুযায়ী বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বিভিন্ন শুমারির আয়োজন করে থাকে। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ১০ বছর অন্তর তথ্যাদি হালনাগাদ করার বিধান রয়েছে। অথচ ২০০৩ সনের পর আর কোনো তাঁতশুমারি হয়নি। এরই মধ্যে তাঁত ও তাঁতিদের পরিসংখ্যানে অনেক হ্রাস/বৃদ্ধি ঘটেছে
 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর  ২০০৩ সনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ তাঁতশুমারি অনুযায়ী দেশে মোট ৫,০৫,৫৬৫ টি তাঁত রয়েছে এবং তাঁত শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে দেশের প্রায় ৮,৮৮,১১৫ জন নারী-পুরুষ কর্মরত আছে। এদের মধ্যে নারী ও পুরুষের সংখ্যা যথাক্রমে ৪,১৫,৭৪৮ ও ৪,৭২,৩৬৭ জন।  
 
বিগত দুটি শুমারির (১৯৯০ ও ২০০৩ সনের) ফলাফল পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে বাংলাদেশে তাঁতের সংখ্যা কমে  যাচ্ছে।  অর্থাৎ ১৯৯০ সালে দেশে মোট ২ লাখ ১২ হাজার ৪২১ টি তাঁত ছিল; যা হ্রাস পেয়ে ২০০৩ সালে হয় ১ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২ টি।  
 
তাঁতশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকার সারাদেশে জরিপ শুরু করেছে। এই জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে বড় প্রকল্প নেবে সরকার।
 
তাঁত শুমারি ২০১৮ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো বাস্তবায়নাধীন তাঁতশুমারি সামনে রেখে  সারাদেশে তাঁতীদের সকল ডাটা সংগ্রহ করা হচ্ছে।
 
প্রকল্প পরিচালক মহিউদ্দিন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশব্যাপী যথাক্রমে ১৯৯০ ও ২০০৩ সালে ১ম ও২য় তাঁতশুমারি পরিচালনা করে। তাঁতশুমারির প্রধান অংশী  হচ্ছে বাংলাদেশ তাঁতবোর্ড এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এ ভূখণ্ডে তাঁতশিল্পের দীর্ঘ ঐতিহ্য রয়েছে। গ্রামীণ অর্থনীতিতে কৃষির পর তাঁতশিল্পের অবদান উল্লেখযোগ্য। সরকার ২০১৮ সালে দেশব্যাপী ৩য় তাঁতশুমারি ২০১৮ পরিচালনা করছে। তাঁতীদের সকল তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সরকার এই ঐতিহ্যকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে চায়। সেই লক্ষ্যেই সারাদেশে জরিপ হচ্ছে। এই জরিপের উপর ভিত্তি করেই বড় প্রকল্প নেয়া হবে তাঁতীদের রক্ষার্থে। আমরা সঠিকভাবে সারাদেশে তাঁতপল্লীর জরিপ পরিচালনা করে যাচ্ছি। ’
 
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৯ ঘণ্টা, মে ১৮, ২০১৮
এমআইএস/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।