ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

সুশোভিত মুকুলের মৌ গন্ধ ছড়িয়ে দানা বেঁধেছে গুটি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ৯, ২০১৮
সুশোভিত মুকুলের মৌ গন্ধ ছড়িয়ে দানা বেঁধেছে গুটি মুকুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঝাঁক ধরে থাকা আমের গুটি

রাজশাহী: রাজশাহীর আকাশে-বাতাসে এখন কেবলই আমের মুকুলের মৌ গন্ধ। গাছের শাখা প্রশাখায় মৃদুমন্দ বাতাসে দোল খাচ্ছে থোকায় থোকায় থাকা সেসব স্বর্ণালী মুকুল। ফাগুনের আগুনমুখো সূর্য মাথার ওপর উঠতেই আম গাছের সবুজ পাতাগুলো চিকচিক করে উঠছে। তার ফাঁক দিয়েই উঁকি দিচ্ছে ঝাঁক ধরে থাকা মগডালের গুটি।

রাতের শীতল হাওয়া আর দিনের গরম আবহাওয়ায় যেনো খাপ খাইয়ে উঠছে আমের ছোট্ট দানাগুলোও। সেই ‘মটর দানাতেই’ স্বপ্ন দেখছেন কৃষক।

তাইতো দিনের সব ব্যস্ততা এখন আম গাছকে ঘিরেই।  

গাছে কীটনাশক স্প্রে, গোড়ায় পানি দেওয়াসহ যত্নের কাজ চলছে পুরোদমে। গেলো কয়েক বছরের তুলনায় এবার রাজশাহীর প্রতিটি গাছে পর্যাপ্ত মুকুল এসেছে। এগুলোর মধ্য আগামজাতের অনেক গাছে এরইমধ্যে গুটি বেঁধেছে আম।  

কৃষকদের প্রত্যাশা কালবৈশাখীর মৌসুমে বড় ধরনের কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে গত কয়েক বছরের তুলনায় রাজশাহীতে এবার আমের বাম্পার ফলন হবে।  

এখন পর্যন্ত মুকুল ও গুটি ঝরার মতো কোনো ক্ষতির মুখে পড়েনি আমগাছগুলো। তবে এমন রূপে শুরু হওয়া খরা পরে রুদ্রমূর্তি ধারণ করলেই বিপদ। এতে গাছ এবং ফলনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তবে শেষ পর্যন্ত তা না হলে আশানুরূপ ফলন হবে বলে স্বপ্ন দেখছেন চাষি ও ব্যবসায়ীরা।

মুকুল থেকে বড় হওয়া মটরদানার মতো আমের গুটিগুলোকে টিকিয়ে রাখতে পরিচর্যা করছেন চাষিরা। তার ওপর মৌসুমের শুরুতেই এবার বৃষ্টি ঝরেছে।  

কৃষিবিদরা বলছেন, এই বৃষ্টি আমের ভালো ফলনের পক্ষেই রয়েছে। এ সময় টানা কয়েক দিন গাছের গোড়ায় পানি ঢেলেও যে লাভ না হতো, তার চেয়েও বেশি লাভ হয়েছে ওই বৃষ্টিতে। বৃষ্টির পানিতে আমের গুটি আকারে বড় হবে, ফলনও হবে বেশি।

এ বছর রাজশাহীতে প্রায় ৯০ শতাংশ গাছে মুকুল এসেছে। সেই মুকুল থেকে এখন ধীরে ধীরে গুটি আসতে শুরু করেছে। আমের প্রায় আড়াইশ’ জাতের মধ্যে আগাম ও মধ্যম জাতের গাছে গুটি এসেছে। দেরিতে গুটি আসবে ফজলি, আশ্বিনাসহ আরও বেশক’টি জাতের।

রাজশাহীর পবা উপজেলার নওহাটা পৌরসভার মথুরা গ্রামের আমচাষি নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, হপার পোকার আক্রমণ দূর করতে সাধারণত দু’বার আমগাছে ওষুধ স্প্রে করতে হয়। এরমধ্যে গাছে পুরোদমে মুকুল আসার পর একবার আর গুটি ধরার পর একবার স্প্রে করতে হয়। এছাড়া গাছের গোড়ায় পানি দেওয়াসহ নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয় মৌসুমজুড়েই। ডিসেম্বরের শেষে মুকুল আসার পর জানুয়ারিতে ওষুধ স্প্রে করা হয়েছে। পুরোদমে গুটি আসার পর মার্চের শেষভাগে আরও একবার স্প্রে করতে হবে। তবে বর্তমানের ঠাণ্ডা-গরম আবহাওয়া নিয়ে একটু দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তারা।

রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বাংলানিউজকে বলেন, মৌসুমের প্রথম বৃষ্টিতে আমের গাছের পাতার ওপর থেকে ধুলা-ময়লা ধুয়ে গেছে। এতে পাতার মাধ্যমে মুকুলগুলো বেশি পরিমাণে সূর্যালোক থেকে খাদ্য গ্রহণ করবে। এ কারণে গুটির ঝরেপড়া যেমন রোধ হবে, তেমনি আকারও হবে বড়। তাছাড়া বৃষ্টির পরদিন পর্যাপ্ত রোদ হওয়ায় মুকুলের রুদ্র কীটপতঙ্গগুলো মারা যাবে। ফলে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এবার আমের ফলন ভালো হবে এমন আশা করেছেন এ বিশেষজ্ঞ।

মুকুলের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঝাঁক ধরে থাকা আমের গুটিরাজশাহীর আম গবেষক মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, রাজশাহীকে বলা হয় আমের রাজধানী। তাই উত্তরের এ জেলায় আম বাগানে মুকুল আসলেই কেনাবেচা শুরু হয়ে যায়। পাতা দেখে মুকুল, মুকুল দেখে আমের কড়ালি (গুটি) এভাবে চাক্রাকারে মৌসুমজুড়েই চলে কেনাবেচা।  

আম ও তার দাম দু’টোই একটু একটু করে বাড়তে থাকে। সব মিলিয়ে একটি আমবাগান চার থেকে পাঁচবার বিক্রি বা হাত বদল হয়। এতে সুস্বাদু এই রসালো আম বাজারের ঝুড়িতে ওঠা ও বিক্রি পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৩শ’ কোটি টাকার কারবার হয়ে থাকে রাজশাহী অঞ্চলে। তাই মৌসুমটির জন্য বছর ধরে শ্রম দেন রাজশাহীর চাষি ও ব্যবসায়ীরা।  

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক দেব দুলাল ঢালি বাংলানিউজকে বলেন, এবার গাছে যখন মুকুল আসা শুরু হয় তখন তীব্র শীত ছিলো। আবার শেষের দিকে গরমও পড়তে শুরু করেছিল। তাই কয়েক বছরের তুলনায় এবার গাছে সবচেয়ে বেশি মুকুল এসেছে। এখন আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে আমের উৎপাদন ভালো হবে।

দেব দুলাল ঢালী বলেন, চাষিরা এখন আমগাছের নিয়মিত পরিচর্যা করেন এবং যত্ন নেন। তাই প্রতি বছরই ভালো ফলন হয়। হুট করে গরম চলে আসলেও আবহাওয়া এখন পর্যন্ত অনুকূলেই রয়েছে। রাতের হালকা শীত আমের উপকারী। তবে এ মাসে হালকা বৃষ্টি হলে তা আরও ভালো হবে। কারণ এতে আমের গাছে আসা গুটি বেশি টিকবে।

জানাতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, রাজশাহীতে প্রায় ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে আম বাগান রয়েছে। প্রতি হেক্টর জমির বাগান থেকে ১০ থেকে ১২ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। সে হিসাবে প্রতি মৌসুমে কমপক্ষে এক লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। কালবৈশাখীর তাণ্ডব না হলে আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি হওয়ার আশা করা যাচ্ছে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।  

এদিকে, উত্তরের জেলা শহরগুলোর মধ্যে রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও পার্শ্ববর্তী নওগাঁ, নাটোর, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁওয়ের প্রায় সব এলাকাতেই নতুন নতুন আমবাগান হয়েছে। প্রতি বছরই বাগানের সংখ্যা বাড়ছে।  

তবে নতুন আমবাগানগুলো প্রায়ই বনেদি জাতের। বিশেষ করে নিয়মিত জাত গোপালভোগ, ল্যাংড়া, ক্ষিরসাপাত ও আশ্বিনা জাতের আমগাছের সংখ্যাই বেশি।

আগামী মে মাসের শেষ দিক থেকে রাজশাহীর বাজারে আম উঠতে শুরু করবে। প্রথমেই উঠবে গুটি আম, জাত আম গোপালভোগ, রানীপছন্দ ও ক্ষিরসাপাত।  

এর এক সপ্তাহের মধ্যেই ল্যাংড়া, লকনা, লক্ষণভোগ, দুধসর, আম্রপালি, মোহনভোগসহ বিভিন্ন জাতের আমে ভরে উঠবে বাজার। এরপর চলতি মৌসুমের আকর্ষণীয় ফল ফজলি এবং সবশেষ আশ্বিনা জাতের আম মিলবে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৯, ২০১৮
এসএস/জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।