ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সপ্তম সংশোধনী অবৈধ: হাইকোর্ট

জাকিয়া আহমেদ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০১২১ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১০
সপ্তম সংশোধনী অবৈধ: হাইকোর্ট

ঢাকা: সংবিধানে সপ্তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। এর মাধ্যমে সাবেক সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ হয়ে গেলো।



একই সঙ্গে দেশে এ পর্যন্ত জারি করা সব সামরিক শাসন ও সামরিক আইনও অবৈধ ঘোষিত হলো। (আরও তথ্যসহ)

সংবিধানের সপ্তম সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটের রায়ে বৃহস্পতিবার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন  চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ ঐতিহাসিক ঘোষণা দেন।

দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে শুরু করে রায় দেওয়া শেষ হয় ২টা ৪৭ মিনিটে।

হাইকোর্ট বেঞ্চ রায়ের অংশে জিয়াউর রহমান নন, এম এ হান্নানকে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণাকারী বলেও উল্লেখ করেন।

আদালত বলেন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে যে ঘোষণা দিয়েছিলেন এটিই ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র এবং  ঘোষণা।

রায়ে বলা হয়, একেবারে শুরু থেকেই জারি করা সব সামরিক শাসনই অবৈধ (ফ্রম দ্য ভেরি বিগিনিং অল মার্শাল ল’জ আর ইললিগ্যাল)।

সংবিধানে পঞ্চম সংশোধনীর বিষয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ের কথা উল্লেখ করে আদালত বলেন, সপ্তম সংশোধনীর বিষয়েও আমাদের একই অভিমত।

রায়ে এরশাদের সামরিক শাসনকে অবৈধ উল্লেখ করে বলা হয়, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ এরশাদের জারি করা সামরিক শাসন, এর পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক আইনের অধীনে জারি করা সব আদেশ, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ফরমান, আদেশ ও নির্দেশ অবৈধ।

তবে ওই সময়ে জনস্বার্থে নেওয়া কার্যক্রম ভবিষ্যত বিশৃঙ্খলা এড়ানোর জন্য মার্জনা করা হয়।

ভবিষ্যতে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল রোধ করার জন্য সংসদ সংবিধান বা দণ্ডবিধিতে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীর শাস্তি নির্ধারণ করতে পারবে বলেও রায়ে বলা হয়। ।

রায়ে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের মতো এইচ এম এরশাদকে অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী বলে উল্লেখ করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এরশাদের এহেন কাজকে মার্জনা করা যায় না। অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী হিসেবে এরশাদ তার দায় এড়াতে পারেন না। সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর ব্যাপারে আপিল বিভাগের দেওয়া চূড়ান্ত রায় অনুযায়ী এ ধরনের অবৈধ ক্ষমতা দখলকারীকে উপযুক্ত শাস্তি (সুইটেবল পানিশমেন্ট) দেওয়া যেতে পারে। তবে সংসদকে এ বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের বিচারিক ইতিহাসের অন্যতম প্রণিধানযোগ্য এ  রায়ে আরো বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে মুজিবনগর সরকার গঠন থেকে সংবিধান কার্যকর করার সময় পর্যন্ত গৃহীত সমস্ত কাজকে ক্রান্তিকালীন বিধান হিসেবে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। ওই অনুচ্ছেদে আর কোনো বিধান যুক্ত করার পথ চিরতরে বন্ধ করা হলো।

সংবিধানে সামরিক আইনের কোনো বিধান নেই উল্লেখ করে আদালত বলেছেন, আর এ কারণেই সামরিক আইন জারি অবৈধ। সংসদ সংবিধান পরিপন্থি কোনো আইন পাস করতে পারে না এবং বৈধতা দিতে পারে না। সামরিক আইন আদেশ অবৈধ হওয়ায় অতীতে এর অধীনে জারি করা সমস্ত কাজ, ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা এবং সেই আদালতে বিচার অবৈধ।

জেনারেল এরশাদকে জিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে উল্লেখ করে এতে আরও বলা হয়, তিনি (এরশাদ) বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধান স্থগিত করেন। এর আগে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জেনারেল জিয়া সামরিক ফরমান বলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সংবিধানের যে মূল নীতি করা হয়েছিলো তা পরিবর্তন করেন। ১৯৮৬ সালে সংসদ গঠিত হলে ওই সংসদে এরশাদের সমস্ত সামরিক ফরমান ও কাজের বৈধতা দেওয়ার জন্য সপ্তম সংশোধনী পাস করা হয়।

আদালত বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদেশি শক্তির সহায়তায় কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সেনাসদস্য হত্যা করে। খন্দকার মোশতাক আহমেদ স্পিকার বা ভাইস প্রেসিডেন্ট না হয়েও অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেন। খন্দকার মোশতাকের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জিয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নেওয়া সংবিধানের মূলনীতি উঠিয়ে দিলেন।

জিয়া বাংলাদেশের সরকারি টেলিভিশন ও বেতারের নাম পরিবর্তন করেন বলেও রায়ে উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়েছে, জিয়াউর রহমান পাকিস্তানপন্থি শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেছিলেন। এছাড়া কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানসহ পাকিস্তানপন্থি অনেককে তিনি পুনর্বাসিত করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনিদের পুনর্বাসিত করতে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়েছেন। সুযোগ করে দিয়েছেন ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করারও।

খন্দকার মোশতাকের সহায়তায় জিয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বিচারের পথ বন্ধ করেছিলেন বলেও রায়ে উলেখ করা হয়।

এর আগে গত ২ ফেব্র“য়ারি সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আবেদন খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। ২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট দেওয়া হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত খন্দকার মোশতাক আহমেদ, আবু সা’দাত মোহাম্মদ সায়েম এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকে বেআইনি ও অবৈধ ঘোষণা করা হয়।

যে কারণে রিট দায়ের

১৯৮৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর চট্রগ্রামে জনৈক আবু তাহেরের লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ তদন্ত করে এটি হত্যা মামলা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নূরুল আনোয়ার, সিদ্দিক আহমেদ এবং নূর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। মামলাটি চট্রগ্রামের দায়রা আদালতে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় এক সামরিক ফরমান বলে মামলাটি সামরিক আদালতে স্থানান্তর করা হয়। পরে আসামিদের অনুপস্থিতিতে তাদের যাবজ্জীবন দণ্ড দেওয়া হয়।

একজন সাধারণ নাগরিকের মামলা কেন সামরিক আাদালতে হবে- এ মর্মে অভিযুক্ত সিদ্দিক আহমেদ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে কারা-অন্তরীণ থাকা অবস্থায় হাইকোর্টে একটি রিট দায়ের করেন। রিটে তিনি উল্লেখ করেন, সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ থেকে ১৯৮৬ সালের ১১ নভেম্বর পর্যন্ত এরশাদের জারি করা সব সামরিক ফরমান ও আদেশকে এবং এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে।

রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৫ এপ্রিল বিচারপতি মমতাজউদ্দিন আহমেদ ও বিচারপতি নাঈমা হায়দারের বেঞ্চ সপ্তম সংশোধনী কেন অবৈধ ও বেআইনি এবং সংবিধান পরিপন্থি হবে না- এ মর্মে রুল জারি করেন। একই সঙ্গে রিটকারী সিদ্দিক আহমেদকেও জামিন দেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৬, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।