ঢাকা: রাজধানীর ফুটপাত বেচাকেনা হয়ে গেছে অনেক আগেই, এখন চলছে মাঝ রাস্তা দখল। কোথাও একচিলতে জায়গা ফাঁকা রাখা হচ্ছে না।
কোথাও কোথাও রাস্তার মাঝখানের আইল্যান্ডেও বাজার বসেছে। চাদর কিংবা পলিথিনের ছাউনি টাঙিয়ে নিচের চট ও ডালা সেজেছে নানা পসরায়।
জবরদখল ও অলিখিত ইজারায় বসেছে এসব দোকানপাট। হকার্স নেতা, পুলিশ ও সিটি করপোরেশন কর্মীদের মতে, এবারই সবচেয়ে বেশি রাস্তা ও ফুটপাত দখল হয়েছে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, নগরীর ২৬টি পয়েন্টে নতুনভাবে বসেছে প্রায় ৩০ হাজার ক্ষুদে দোকান।
ফুটপাতে পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুট আয়তনের প্রতিটি দোকানের জায়গা বিক্রি হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকায়। রাস্তাগুলোতে কিছুটা ঝুঁকি আছে তাই দরও কিছুটা কম। রাস্তায় একই মাপের জায়গা বিক্রি হচ্ছে তিন থেকে চার হাজার টাকায়। আর এ অর্থ ভাগ বাটোয়ারা হয়ে যাচ্ছে পুলিশ, সিটি করপোরেশন কর্মী, রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী ও এলাকাভিত্তিক মাস্তানদের পকেটে।
কেবল জায়গা কিনেই শেষ নয় ঝক্কি ঝামেলা মেটাতে প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদাও দিতে হচ্ছে ক্ষুদে ব্যবসায়ীদের।
ফার্মগেটের একদল ক্ষুদে ব্যবসায়ী জানান, প্রতিদিন ‘পুলিশের বিট’ বাবদ ২০ টাকা, ‘হকারদের কল্যাণকারী নানা সংগঠনের চাঁদা’ বাবদ ১০ টাকা এবং স্থানীয় কাব-সমিতির নামে ‘মাস্তানি ভাতা’ বাবদ আরও ১০ টাকা দিতে হয়। এ চাঁদা আদায়ে লাইনপ্রতি একজন দোকানদার ‘লাইনম্যান’-এর দায়িত্ব পালন করেন। ওই দোকানি থাকেন চাঁদামুক্ত। কয়েকটি লাইন মিলিয়ে গড়ে উঠে একটি জোন।
গুলিস্তান এলাকা মোট ১৫টি জোনে বিভক্ত। এগুলোর চাঁদা আদায়ের দায়িত্ব কালু, মিজান, পুইরা হারুন, একটি রাজনৈতিক সংগঠনের শ্রমিক নেতা আনোয়ার, মজনুসহ কয়েকজনের। একইভাবে মতিঝিল-দিলকুশায় ছয়টি, নিউমার্কেট থেকে সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড় পর্যন্ত পাঁচটি, পল্টন-বায়তুল মোকাররম এলাকায় চারটি, ফার্মগেটে তিনটি এবং মালিবাগ মোড়, মৌচাক-মালিবাগ, মিরপুর-১ ও মিরপুর-১০ নম্বর চত্বর এলাকায় দুটি করে জোন রয়েছে।
বায়তুল মোকাররম মসজিদসংলগ্ন উত্তর পাশে রাস্তার ওপরই দোকান দিয়ে বসেছেন ক্ষুদে ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক। বিস্তারিত কোনো পরিচয় দিতে রাজি না হওয়া এ ব্যবসায়ী বলেন, ‘চার হাত বাই পাঁচ হাত জায়গায় দোকান বসাতে এককালীন দিয়েছি তিন হাজার টাকা। পরে জায়গা নিয়ে পাশের দোকানির সঙ্গে ঝগড়া হওয়ায় আরও দুই হাজার টাকা জরিমানা দিয়েছি। এছাড়া প্রতিদিন ৫০ টাকা চাঁদা দিই।
তিনি বলেন, ‘বেচাকেনা ভালো বলেই পুষিয়ে যাচ্ছে। ’
আরেক ব্যবসায়ী ইউসুফ আলী বলেন, ‘ফুটপাত ও রাস্তায় আমাদের মতো ুদ্র ব্যবসায়ীদেরই বিজনেস করার কথা। অথচ সেখানে পজিশন নিয়ে আছে বড় বড় দোকানের মালিকরাও। ’
তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে এক মার্কেটের বড় ব্যবসায়ী তুলা মিয়াও ফুটপাতে পজিশন কিনে তার কর্মচারীদের দিয়ে দোকান বসিয়েছেন। তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কুলিয়ে উঠা যায় না। ’
একটি রাজনৈতিক দলের যুব সংগঠনের ব্যানারে চাঁদা তোলা হচ্ছে ফার্মগেট টেম্পো স্ট্যান্ডের আশপাশের হকারদের কাছ থেকে। এখানে চাঁদা তুলেন তৌহিদ, কাজল, মোফাজ্জল, তারাসহ আরও ক’জন। কারওয়ানবাজারের মূল রাস্তাটি অলিখিত ইজারা দিয়ে চাঁদা তুলছেন শ্রমিক ও যুবদলের তিন নেতা। আম্বরশাহ মসজিদ গলি বন্ধ করে গড়ে তোলা মুড়ির বাজার থেকে চাঁদা তুলে আরেকটি সিন্ডিকেট।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার একেএম শহিদুল হক বলেন, ‘সামনে ঈদ। এসময় তাদের উচ্ছেদ ও গ্রেপ্তার অমানবিক হয়ে দাঁড়ায়। ঈদের পর থেকেই উচ্ছেদ অভিযান জোরদার করা হবে। ’
তিনি জানান, গত এক সপ্তাহে ফুটপাত দখল, চাঁদাবাজি ও অবৈধ দোকানপাট গড়ে তোলার অভিযোগে মহানগরের বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৮৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
এদিকে, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র প্রতিবেদকের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানের ফুটপাত মার্কেটের অবস্থান, চাঁদার পরিমাণ ও চাঁদা আদায়কারীদের তালিকা।
রাজধানীর গুলিস্তানে এমন দোকান ২২০টি। এগুলোর দৈনিক চাঁদার হার ১০০ থেকে ২০০ টাকা। সর্দার আবদুস সালাম এখানকার লাইনম্যান। মতিঝিলের জনতা ব্যাংক ভবনসংলগ্ন ফুটপাতে রয়েছে প্রায় ২৫০টি। এখানকার লাইনম্যানরা হলেন- বড় হারুন, লিটন ও চুইলা বাবু। এখানে চাঁদার হার ৮০ থেকে ১০০ টাকা। গুলিস্তানের রমনা ভবনের সামনে বসা প্রায় ২০০টি দোকান চাঁদা দিচ্ছে ৯০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত। চাঁদা তুলেন সেলিম ও রানা। শাহবাগ শিশুপার্ক গেট এলাকার প্রায় ৮০টি দোকান থেকে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা আদায় করছেন নজির আহমেদ ও আক্কাস।
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ২৪, ২০১০