এ সময় জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণের আহবান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে শরণার্থী সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের কিছু উপায়ও বাতলে দেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আমি জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আহবান জানাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে পেশ করা তার সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- প্রথমত, অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা; দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘ মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল (Fact Finding Mission) প্রেরণ করা; তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় (safe zones) গড়ে তোলা; চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য হতে জোরপূর্বক বিতাড়িত সকল রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
ভাষণে রোহিঙ্গা ইস্যু ছাড়াও বিশ্বব্যাপী শান্তি রক্ষা কার্যক্রম, সন্ত্রাস বিরোধী কার্যক্রমে সহায়তা, জলবায়ু পরিবর্তন, অর্থনীতি বিষয়েও সময়োপযোগী ও দূরদর্শী বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের চালানো গণহত্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির চিত্রও ফুটিয়ে তোলেন প্রধানমন্ত্রী।
ভাষণের শুরুতেই ৭২তম অধিবেশনের সভাপতিকে আন্তরিক ও উষ্ণ অভিনন্দন জানান শেখ হাসিনা। তার দায়িত্ব পালনে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবকল্যাণ, শান্তি ও টেকসই ধরিত্রী- আপনার এই তিন প্রাধিকারের প্রতি আমার অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করছি। তবে আমার মন আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত।
শেখ হাসিনা বলেন, আমার চোখে বারবার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীত-সন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি। আমি মাত্র কয়েকদিন আগেই আমার দেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি, যারা ‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে আজ নিজ দেশ থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত। অথচ তারা হাজার বছরেরও অধিক সময় যাবত মিয়ানমারে বসবাস করে আসছেন।
এদের দুঃখ-দুর্দশা আমি গভীরভাবে অনুধাবন করতে পারি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার বাবা, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করার পর আমি আমার ছোট বোনকে নিয়ে ৬ বছর উদ্বাস্তু জীবন কাটিয়েছি।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এখানে ভাষণ দেয়ার সময় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তাঁর অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন।
সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন: ‘এমন এক বিশ্বব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সকল মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে। এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে”।
আমরা এই মুহূর্তে নিজ ভূখণ্ড হতে বিতাড়িত ৮ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা দিয়ে যাচ্ছি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। এই নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। আন্তর্জাতিক আভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, গত তিন সপ্তাহে চার লাখ ত্রিশ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। এ সব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারেন এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে।
‘একই সঙ্গে আমি সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের প্রতি নিন্দা জ্ঞাপন করছি। এ বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে’ বলে মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় আমি নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ও জাতিসংঘের মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, বাংলাদেশ নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত অভিবাসনকে উৎসাহিত করে । Global Compact on safe orderly and regular migration-এর মাধ্যমে একটি সুস্থ ধারার অভিবাসন-কাঠামো তৈরির জন্য গত বছর আমরা একটি প্রস্তাব পেশ করেছি। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এ প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে আজ অভিবাসন এবং উদ্বাস্তু সংক্রান্ত Compact গঠনের বিষয়ে জাতিসংঘে আলোচনা চলছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে প্রধানমন্ত্রী গত ১৬ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছাড়েন। এবারের অধিবেশনে তিনি ৫২ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ সরকারি প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
** সন্ত্রাস মোকাবেলায় জাতিসংঘে ৩ প্রস্তাব হাসিনার
**জাতিসংঘে শান্তি, উন্নতি ও কল্যাণ প্রত্যাশা শেখ হাসিনার
** জাতিসংঘের ২ তহবিলে ২ লাখ ডলার অনুদান ঘোষণা হাসিনার
ফের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা শুরুর আহবান শেখ হাসিনার
গণহত্যার বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ চান হাসিনা
রোহিঙ্গা সমস্যায় কার্যকর উদ্যোগ নিন: জাতিসংঘকে হাসিনা
পানি অধিকার, সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নজর দিন
বাংলাদেশ সময়: ০৫৪৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৭
জেডএম/