ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘মায়ের মতো সাথী পেয়েছিলেন বলেই বাবা সফল’

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৮, ২০১৭
‘মায়ের মতো সাথী পেয়েছিলেন বলেই বাবা সফল’ বঙ্গমাতার ৮৭তম জন্মবার্ষিকীতে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

ঢাকা: মায়ের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বারবার চোখের জল মুছছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।বলছিলেন, আসলে আমার আব্বা আমার মায়ের মতো একজন সাথী পেয়েছিলেন বলেই তিনি তার সংগ্রাম সফল করতে পেরেছিলেন।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সংগ্রামী জীবনে প্রেরণা হয়ে তার পাশে ছিলেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। তার সহযোগিতা ও আত্মত্যাগ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে তার অবদান এবং ১৫ আগস্টের নির্মমতার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট ও অধ্যায়ের পটভূমি তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

এসব কথা বলতে গিয়ে বারবার অশ্রুসিক্ত ও আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়তে দেখা যায় তাকে।

মঙ্গলবার (০৮ আগস্ট) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছিলেন প্রধানমন্ত্রী।

মায়ের অবদান ও ত্যাগের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, জীবনে সব আশা আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে, সব ভোগ বিলাসিতা এড়িয়ে আমার বাবার পাশে প্রেরণা হিসেবে থেকে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আমার মা।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, কতো ত্যাগই না আমার মা করে গেছেন, আমার বাবার পাশে থেকে থেকে। এভাবে যদি ত্যাগ স্বীকার না করতেন তাহলে আজকে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম কিনা? 

'বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কখনো পাকিস্তান যাননি এবং যেতে চাননি' জানিয়ে তিনি বলেন, এদেশের স্বাধীনতার জন্য তিনি সব সময় ছিলেন দৃঢ়চেতা। এমনটা পৃথিবীতে বিরল।

১৫ আগস্টে সপরিবারে শহীদ হ্ওয়া বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের অবদানের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভে আমার মায়ের অবদান অনেক। এজন্য বোধ হয় আমার মায়ের ওপর ওদের আক্রোশ ছিলো।  

শেখ হাসিনা বলেন, আমার মা সারাটা জীবন কষ্ট করে গেলেন, তার বাবা মা হারিয়ে। তারপর ১৫ আগস্ট ছেলে, ছেলের বউ, স্বামী সবাইকে নিয়ে চলে গেলেন। ওরা (ঘাতকরা) নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করলো সবাইকে।

মাত্র ৫ বছর বয়সের মধ্যে বঙ্গমাতা তার বাবা-মা তার মাকে হারিয়েছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

মায়ের সাহস আর ধৈর্যের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমার মায়ের অসম্ভব ধৈর্য ছিলো। যে কোনো পরিস্থিতি তিনি সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করতেন। তার ছিল অসীম ত্যাগ স্বীকার করার মনোভাব।

আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বার বার জেল খাটা এবং তার অবর্তমানে বঙ্গমাতার দল পরিচালনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মা বসে থাকেননি, একদিকে বাবার মামলা মোকাদ্দমা চালানো, বাড়ি খোঁজা, সংগঠনের নেতা-কর্মীদের খোঁজ খবর নেয়া সবই তাকে করতে হতো।  

তিনি বলেন, মার্শাল ল’, রাজনীতি নিষিদ্ধ, ওই অবস্থায় বলতে গেলে আওয়ামী লীগের সব নেতা জেলে। যারা জেলে তাদের খোঁজ নেয়া, তাদের মধ্যে অনেকে অসুস্থ ছিলেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা নেয়া, আর্থিক সহযোগিতা করা সব্তই করেছেন মা।  

বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দলের নেতা-কর্মীদের সহযোগিতা করতে গিয়ে বঙ্গমাতা ঘরের আসবাবপত্র বিক্রি করতেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এগুলো করতে গিয়ে কখনো… যেমন আমাদের ফ্রিজটা বিক্রি করে দিলেন, সোফাসেট বিক্রি করে দিলেন, হাতের গহনা বিক্রি করতেন কিন্তু কখনো কোনো হা-হুতাশ করতেন না... আমাদের বলতেন ফ্রিজের পানি খেলে ঠাণ্ডা লাগে, ফ্রিজ রাখা ঠিক না, তোমাদের খামোখা সর্দি-কাশি হয়ে যায়।

‘সোফাসেট যেদিন বিক্রি করে দেন সেদিন বলেছিলেন, এটা ছোট ঘর। জায়গা নেই।  তাছাড়া এটা পুরোনো ডিজাইনের।  এটা বিক্রি করে দিই। পরে আমরা নতুন একটা কিনবো। ’

আর্থিক অনটনে কখনো কখনো  বাজার করা হতো না জানিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, মা তাদের দেখতে যেতেন, আর্থিক সহযোগিতা করতেন। এভাবে সবাইকে দেখতে গিয়ে অনেক সময় এমন হতো যে বাজারই করতে পারেন নাই। ... সেদিন খিচুড়ি রান্না করতেন। আচার দিয়ে আমাদের খেতে দিতেন। বলতেন রোজ রোজ ভাত খেতে কী ভালো লাগে। চল আজকে আমরা গরিব খিচুড়ি খাবো।

‘তিনি যে বাজার করতে পারছেন না, বাজার করার টাকা নেই। এই কথাটা কখনো বলতেন না। ’

বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দৃঢ়তার কথা তুলে ধরতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ছয় দফার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এসে আমার মাকে বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে, ছয় দফা দিয়ে কী হবে! আট দফা হলেই ছয় দফার চাহিদা পূরণ হবে। আমরা মায়ের একটাই কথা ছিলো, ‘না, ছয় দফা তো ছয় দফাই। ’


‘তারা ছয় দফা বাদ দিয়ে আট দফা গ্রহণ করার জন্য চাপ দিতে থাকলেন। ’

আগরতলা মামলা চলাকালীন সরকারবিরোধী তুমুল আন্দোলনের মধ্যে বিরোধীদলসহ সবার সঙ্গে আলোচনার জন্য আইয়ুব খানের বৈঠকের ডাক এবং বঙ্গবন্ধুকে প্যারোলে ওই বৈঠকে নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রায় সব নেতারাই রাজি ছিলেন যে, আব্বা প্যারোলে যান। কিন্তু, আমার মা কখনোই এর সঙ্গে একমত ছিলেন না।

শেখ হাসিনা বলেন, আমার মনে আছে, মা আমাকে খবর দিলেন, ‘তুমি শিগগরি আসো, তোমাকে এক্ষুণি যেতে হবে (ঢাকা সেনানিবাস)। ওখানে প্যারোলে নেবার জন্য সবাই অস্থির উৎগ্রীব, তোমার আব্বা যেনো না যায়।  

‘উনি (মা) ডিরেকশন দিলেন, আর মণি ভাই লিখে দিলেন। … হয়তো সুযোগ পেলে চিঠিটা দেবো, নয়তো মেসেজটা দেবো। ’ 

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ওখানে গিয়ে যখন দাঁড়িয়ে আছি, আমাদের বড় বড় নেতারা সবাই কিন্তু ভেতরে। তেজগাঁও এয়ারপোর্ট.. সেখানে কিন্তু প্লেন রেডি। সেখানে গিয়ে দেখলাম মানিক কাকার (তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) গাড়ি। সেই গাড়িতে করে আমাদের নেতা তাজউদ্দিন সাহেব (তাজউদ্দিন আহমেদ), সালাম খান, ড. কামাল (কামাল হোসেন), আমিরুল ইসলাম (ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম).. এরা সবাই উপস্থিত। সঙ্গে আরকেজনও ছিলো, সে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা না হলেও সব সময় সাথে সাথে ঘুর ঘুর করতো। সেটা হচ্ছে, মওদুদ আহমেদ। ’

‘আমাকে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে না। আমি কিন্তু গেটের বাইরে দাঁড়ানো। … আমি খুব উসখুস করছি, আব্বা যদি একটু বের হন, আব্বা যদি জানতে পারেন আমি আছি.. আমার উপস্থিতিটা উনি বুঝতে পারবেন; মা কোনো মেসেজ দিয়ে পাঠিয়েছে। ’

তিনি বলেন, ‘আব্বা কথা বলতে বলতে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, দেখলেন আমি দাঁড়ানো। উনি হেঁটে বাইরে এলেন। ওনাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছে না। নিচু কাঠের গেট। কাঠের গেগটা একটু ফাঁক করা। ওখান থেকে উনি আমাকে আদর করার জন্য গলাটা জড়িয়ে ধরে বললেন, কোনো চিঠি টিঠি দিস না, তোর মা কি বলেছে বল। আমি শুধু বললাম, ‘মা এখনো প্যারোলে যেতে নিষেধ করেছে, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছে। উনি সময় চেয়েছেন। সময় পেলে উনি আসবেন। মা নিষেধ করেছে যেতে। আপনি কিন্তু যাবেন না’।

‘আমাদের নেতারা বোধ হয় এটা খুব একটা ভালো চোখে দেখলেন না। ..’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আসার আগেই ওনারা পৌঁছে গেছেন। দেখি নিচের তলায় সব নেতারা বসা। তারা মাকে বললেন, আপনি এটা কী করলেন ভাবি। ওনারা বুঝে গিয়েছিলেন, আমি যখন গিয়েছি কোনো মেসেজ নিয়ে গেছি এবং আব্বা বেরোবেন না। তখন তারা মাকে বললেন, আপনি কি জানেন- আপনি বিধবা হবেন? মা শুধু বলেন, আমি একা কেন সঙ্গে তো আরো ৩৪ জন আসামি আছে! 

‘তাদেরও তো স্ত্রী আছে। বিধবা তো তারাও হবে! তাছাড়া বাংলাদেশের কি হবে? কি হবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, দেশের কথা আগে চিন্তা করেন। আমার কথা চিন্তা করতে হবে না। ’

শেখ হাসিনা বলেন, মাকে মানাতে না পেরে .. আমি বারান্দায় দাঁড়ানো-- ওখান থেকে দুই নেতা উঠে এলেন। একজন আমিরুল ইসলাম, তার সাথে সাথে তার লেজে-লেজে থাকতো আর কি, মওদুদ আহমেদ। এই দুইজন এসেই আমাকে সামনে পেয়েই আমিরুল ইসলাম খুব কঠিন ভাষায় বললেন, তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাও না তোমার আব্বা মুক্তি পাক?’

‘আমার নিজেরও খুব রাগ হলো। আমি বললাম, আমার আব্বা মুক্তি পাবেন এবং সম্মানের সঙ্গে মুক্তি পাবেন, মাথা উঁচু করে মুক্তি পাবেন। আপনারা উল্টাপাল্টা করবেন না। ’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই যে তার (বঙ্গমাতা) দৃঢ় মনোবল। আজকে আমরা স্বাধীন দেশ পেয়েছি, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমার বাবার প্রতিটি সিদ্ধান্তে আমার মায়ের যে অবদান সেটাই এখানে প্রতিফলিত হলো। ’

‘জনগণ কী চায় তা বোঝা ও জনমত সৃষ্টি করার পেছনে মায়ের বিরাট অবদান ছিলো। ’ 
 
৭ মার্চের ভাষণে কিছু নেতার পরামর্শ না শুনে নিজের আবেগ ও জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বক্তব্য রাখার পরামর্শ দিয়েছিলেন বঙ্গমাতা।  জানালেন প্রধানমন্ত্রী।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির সভাপতিত্বে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান মমতাজ বেগম, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি রেবেকা মমিন ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাংসদ ফজিলাতন্নেসা বাপ্পী। আর স্বাগত বক্তব্য রাখেন, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব নাছিমা বেগম।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৬ ঘণ্টা, আগস্ট ০৮, ২০১৭
এমইউএম/এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।