ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মামলার রায় শুনতে আদুরী ঢাকায়

আবাদুজ্জামান শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
মামলার রায় শুনতে আদুরী ঢাকায় চার বছর ধরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন আর শারীরিক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলেছে আদুরী (ফাইল ফটো)

ঢাকা: নিজের ওপর চার ‍বছর আগে ঘটা নির্মম-নিষ্ঠুর নির্যাতনের মামলার রায় শুনতে ঢাকায় এসেছে আদুরী। সঙ্গে আছেন তার মা সাফিয়া বেগম, মামা মামলার বাদী নজরুল চৌধুরীসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা।

পটুয়াখালী থেকে লঞ্চযোগে সোমবার (১৭ জুলাই) সকালে ঢাকায় আসে বর্তমানে ১৪ বছরের কিশোরী আদুরী ও তার পরিবার।

চার বছর আগের ১১ বছরের শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে নির্যাতন করে মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়ার ওই আলোচিত মামলার রায় মঙ্গলবার (১৮ জুলাই) দেবেন ঢাকার ৩নং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল।

সকালে ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার রায় ঘোষণা করবেন।      

মামলার বাদী আদুরীর মামা নজরুল চোধুরী বাংলানিউজকে জানান, রায় শুনতে পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠি ইউনিয়নের পূর্ব জৈনকাঠি গ্রামের বাড়ি থেকে আদুরী ও পরিবারের বেশ কয়েকজনকে নিয়ে এসেছেন তারা। উত্তর বাড্ডায় আদুরীর দুলাভাইয়ের বাসায় অবস্থান করছেন।

আদুরীসহ তারা সবাই রায় শুনতে সকালে ট্রাইব্যুনালে যাবেন বলেও জানান তিনি।

অল্প বয়সে বাবাকে হারানোর পর অভাবের কারণে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে পটুয়াখালীর বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে আদুরী হয় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর নির্মম নির্যাতনের শিকার। তাকে মারধর, গরম ইস্ত্রি, খুন্তি, চামচ বা তেলের ছ্যাঁকা, ব্লেড দিয়ে শরীর পোঁচানো, মাথায় কোপ, মুখে আগুনের ছ্যাঁকা, খেতে না দেওয়াসহ ভয়াবহ সব নির্যাতন চালানোর পর মৃত ভেবে ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিলেন নদী।

চার বছর আগে হাসপাতালে চিকিৎসার সময় মৃতপ্রায় আদুরী (ফাইল ফটো)২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় রাজধানীর বারিধারা ও ডিওএইচএস তেলের ডিপোর মাঝামাঝি রেললাইন সংলগ্ন ওই ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় কঙ্কালসার ও মৃতপ্রায় শিশু গৃহকর্মী আদুরীকে।

এক নারী ও ক্যান্টনমেন্ট থানা পুলিশ  অর্ধমৃত অবস্থায় আদুরীকে  উদ্ধার করে সন্ধ্যার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে আসে।

তখন আদুরীর শরীরে ছিলো অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন। মাথাসহ শরীরের সব জায়গায়ই ছিল পুরনো আঘাতের চিহ্ন ও ঘা। কথা বলা তো দূরের কথা, উঠে বসার শক্তিও ছিলনা তার। শিশু আদুরীর পরনে ছিল শুধু একটি ময়না লাল রঙের পাতলা কাপড়ের হাফ প্যান্ট।

অর্ধ কঙ্কাল অবস্থায় ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার হওয়া আদুরীকে নিয়ে একের পর এক সংবাদ হতে থাকে গণমাধ্যমে।  

তিনদিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর আদুরীর মামা নজরুল চৌধুরী পল্লবী থানায় গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদী, তার স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, মাসুদের দুলাভাই চুন্নু মীর ও তাদের আত্মীয় রনিকে আসামি করে নির্যাতনের মামলাটি করেন। তবে পুলিশি তদন্তে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় চার্জশিট থেকে মাসুদ,  চুন্নু মীর ও রনিকে বাদ দেওয়া হয়। তদন্তে নদীর মা ইসরাত জাহানকে নতুন করে তাকে আসামি করা হয়।

চার বছরের বিচারিক কার্যক্রম শেষে নদী ও তার মা ইসরাতের বিরুদ্ধে রায় হচ্ছে মঙ্গলবার। নদী কারাগারে আটক থাকলেও জামিনে আছেন তার মা ইসরাত।

ঢামেক হাসপাতালে প্রায় দেড় মাসের চিকিৎসার পর যখন আদুরীকে রিলিজ দেওয়া হয়, তখনও সে ভালোভাবে কথা বলতে পারতো না। শরীর ছিলো প্রচণ্ড দুর্বল। তারপরও মা আর ভাই-বোনদের সঙ্গে থাকতে ক্ষতচিহ্ন নিয়েই ওই বছরের ০৭ নভেম্বর বাড়িতে চলে যায় আদুরী।

অভাব আর ধার-দেনা জর্জরিত বড় ভাই মো. সোহেল মৃধার সংসারে বাবাহীন আদুরী স্থানীয় পূর্ব জৈনকাঠি সালেহিয়া দাখিল মাদ্রাসায় তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে।

সোমবার আদুরীর মা সাফিয়া বেগম জানান, তার ৯ ছেলে-মেয়ের মধ্যে আদুরী ৭ নম্বরের। ছেলে-মেয়েদের বাবা খালেক মৃধা মারা গেছেন ৬/৭ বছর। ডাস্টবিন থেকে মুমূর্ষু আদুরীকে উদ্ধারের এক বছর আগে স্থানীয় ঠিকাদার চুন্নু মিয়া আদুরীকে তার শ্বশুর বাড়িতে কাজে নেন। এরপর সেখানে থেকে চুন্নু মিয়া তার স্ত্রীর ভাই সাইফুল ইসলাম মাসুদের বাড়িতে ঢাকায় কাজে পাঠান। ওই বাড়িতেই শিশুটিকে অনেকদিন ধরে নির্যাতন চালানো হচ্ছিল মাসুদের স্ত্রী নদীর নেতৃত্বে।

বড় ভাই সোহেল মৃধা  জানান, গত চার বছর ধরে নির্যাতনের ক্ষতচিহ্ন আর শারীরিক যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে চলেছে আদুরী। টাকার অভাবে সঠিক চিকিঃসা না পেয়ে
শরীরজুড়ে থাকা ক্ষতচিহ্নগুলোর অনেক স্থানেই শক্ত টিউমারের মতো হয়ে গেছে। রাতের বেলা প্রচণ্ড যন্ত্রণা আর চুলকানিতে ঘুমাতে পারে না। নির্যাতনের সময় গৃহকর্ত্রী নদী আগুনের ছ্যাঁকা দেওয়ায় জিহবা ক্ষতিগ্রস্ত, তাই স্বাভাবিক মানুষের মতো কথাও বলতে পারে না। সামনে বসেও অস্পষ্ট শুনতে পাওয়া যায় তার মুখ থেকে বের হওয়া কথাগুলো।

নির্যাতনের সব বিষয় আদুরীর এখন মনে না থাকলেও অস্পষ্ট ভাষায় বাংলানিউজকে সে বলে, ‘এর বিচার আমি চাই’।

সোহেল মৃধা আরও বলেন, ‘আমার বোনরে যে নিয়া এই দোজগের আগুনে ফালাইছছেন, সেই চুন্নু মিয়া আগে থাইকা ছাড়া পাইয়া গেলেন, এখন কি হবে তাও আল্লাহই জানেন। অহন বাকি আসামিগো শাস্তি চাই’।
 
রায় শুনতে সপরিবারে ঢাকায় এসেছে আদুরী মা সাফিয়া বেগম আরও বলেন, ‘যতোই অভাব-অনটন থাউক, আইজ মাইয়াডার দশা এইরহম অইবে হ্যা বোঝলে কামে দেতাম না। তারে যারা এই দশা করছে, তাগোর কঠিন শাস্তি চাই’।  

নদী ও তার মায়ের উপযুক্ত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চান মামা নজরুলও।     

নির্যাতিত আদুরীর পক্ষে মামলাটি পরিচালনা করেন বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির অ্যাডভোকেট ফাহমিদা আক্তার রিংকি। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা অভিযুক্ত আসামিদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আমরা সঠিক রায় প্রত্যাশা করছি’।

বাংলাদেশ সময়: ২১১৭ ঘণ্টা, জুলাই ১৭, ২০১৭
এজেডএস/এমএস/আরআই/এএসআর
 

আগুনের ছ্যাঁকায় ক্ষত জিহবায় কথাও আটকে যাচ্ছে আদুরীর

** লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায় আদুরী

** এখনো ক্ষত-যন্ত্রণা বয়ে চলেছে আদুরী
** ‘আমি নদীর ফাঁসি চাই’

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।