ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

‘দেহব্যবসায় রাজি না হওয়ায় আবাসিক হোটেলে নৃশংসভাবে খুন’

সীমা নামের আরেক শবমেহের!

সাঈদুর রহমান রিমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১০
সীমা নামের আরেক শবমেহের!

ঢাকা: প্রায় দেড় যুগ আগে নারায়ণগঞ্জের টানবাজারে সীমাহীন বর্বরতার শিকার হয়ে করুণ মৃত্যু ঘটেছিল শবমেহেরের। যৌনপল্লীতে আটকে রেখে শবমেহেরকে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করা হয়েছিল।

তারই মতো আরেক তরুণী সীমা আক্তার ওরফে স্বর্ণরূপা(১৯)। বনানীর ‘লর্ডস ইন’ আবাসিক হোটেলের ৫ তলার এক নির্জন কক্ষে আটকে  রেখে দেহব্যবসায় রাজি করাতে ব্যর্থ হয়ে নৃশংসভাবে খুন করা হয় সীমাকে।

হোটেল কক্ষে দেহ ব্যবসায়ী চক্রের ৭/৮ জন দালাল সীমার উপর রাতভর পাশবিক নির্যাতন চালায়। এরপর সীমাকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। তিনদিন ব্যাপী অনুসন্ধান চালিয়ে মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন’-এর (এইচআরএইচএফ) তৈরি করা এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে নৃশংসতার চিত্র।  

ওই প্রতিবেদনে গুলশান থানা পুলিশের দায়িত্বহীনতা ও দেহ ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে যোগসূত্রের কথা বলা হয়েছ্। রোববার প্রতিবেদনটি ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও মহাপুলিশ পরিদর্শকের দপ্তরে দাখিল করা হবে বলে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানিয়েছেন এইচআরএইচএফ মহাসচিব আলমগীর সেলিম। সীমার নৃশংস হত্যাকান্ডের ব্যাপারে মামলা করারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

গুলশান থানার ওসি কামাল উদ্দিন আবাসিক হোটেলে সীমাকে হত্যার অভিযোগ পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তবে হোটেলের দেহ ব্যবসায়ী চক্রের সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন তিনি। বৃহস্পতিবার রাতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে তিনি বলেন, প্রথমে কথিত স্বামীর হাতে সীমার খুন হওয়ার খবর পাওয়া গেলেও এখন বেরিয়ে আসছে ভিন্ন তথ্য। এ হত্যাকান্ডে আবাসিক হোটেল ঘিরে সংঘবদ্ধ দেহব্যবসায়ী চক্রের হাত আছে। ’
ওসি জানান, সীমা হত্যার রহস্য উদঘাটনে পুলিশি তদন্ত শুরু হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে ময়না তদন্ত শেষে ভিসেরা রিপোর্টের জন্য সীমার দেহের প্রয়োজনীয় অংশ মহাখালীর জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে।

১৭ আগস্ট ভোরে হোটেলের ৫০৩ নম্বর কক্ষে সীমার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন হোটেলবয়রা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, প্রেমের অভিনয়ে দেহ ব্যবসায়ী চক্রের এক সদস্য সীমাকে লর্ডস ইন হোটেলে নিয়ে তোলে। সেখানে তাকে দেহব্যবসায় নামানোর চেষ্টা চলতে থাকে। সীমা কিছুতেই রাজি না হওয়ায় ১৬ আগস্ট দিনগত সারারাত তার উপর চলে নির্যাতন। একপর্যায়ে ৭/৮ জন দালাল সীমাকে মারধোর করে ৫০৩ নম্বর কক্ষে নিয়ে গিয়ে ‘গ্যাং রেপ’ করে।

হোটেলটির একাধিক কর্মচারীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, উপর্যুপরি পাশবিক নির্যাতনের কারণে মাঝরাতে সীমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তবুও থামেনি পাশবিকতা। সেহ্রীর সময় সীমাকে অচেতন অবস্থায় ৫০৩ নম্বর কক্ষে ফেলে রেখে সট্কে পড়ে দালালরা। পরে হোটেল কর্মচারী শহিদ ও তারেক নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা সীমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক সীমাকে মৃত ঘোষণা করতেই শহিদ ও আবু তাহের পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালান। এসময় হাসপাতাল গেটের পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের আটক করে শাহবাগ থানায় পাঠান।


এদিকে, এই দুই জনকে আটক করা হয়েছে খবর পেয়ে লর্ডস ইন হোটেলের ম্যানেজার নূরুজ্জামান তড়িঘড়ি গুলশান থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা (ইউডি মামলা) দায়ের করেন। মামলার এজাহারে তিনি দাবি করেন, রফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি স্ত্রী পরিচয় দিয়ে সীমাকে নিয়ে হোটেলে ওঠেন। সেহ্রীর পর রফিকুল হোটেল থেকে বেরিয়ে যান। পরে সন্দেহ হওয়ায় ওই কক্ষে গিয়ে সীমাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেন তারা।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিজিটাল ক্যামেরায় হোটেল বোর্ডারদের ছবি তোলা বাধ্যতামূলক হলেও রফিকুলের ছবি তোলা হয়নি।


তদন্ত টিমের সদস্যদের প্রশ্নের মুখে হোটেলের ম্যানেজার ও কর্মচারীরা নানা বিভ্রান্তিমূলক কথাবার্তা বলেন। ম্যানেজার নূরুজ্জামানকে উদ্ধৃত করে তদন্ত প্রতিবেদনে লেখা হয়, ‘সীমা এ হোটেলে নিয়মিত আসা যাওয়া করায় আগে থেকেই পরিচিত। এ কারণে ক্যামেরায় তাদের ছবি তোলার প্রয়োজন মনে করিনি। ’ পরক্ষণেই তিনি বলেন, ‘রফিকুল একেক দিন একেক মহিলাকে নিয়ে স্ত্রী পরিচয়ে হোটেলে উঠতেন। তাকে সবাই চিনি, ছবি তোলার দরকার কি ?’


এদিকে মানবাধিকার সংগঠনটি তদন্ত শুরু করার পরপরই মর্গ থেকে লাভলু নামে এক ব্যক্তি স্বামী পরিচয় দিয়ে সীমার মৃতদেহ নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে গুলশান থানার অফিসার ইনচার্জ কামাল উদ্দিন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘আড়াই হাজার উপজেলার ইউএনও’র সুপারিশে মৃতদেহটি লাভলুর কাছে দেওয়া হয়েছে। ’ লাভলুর বাড়ি বাগেরহাট জেলার চিতলমারী থানার চিলমারী গ্রামে বলে তার দেওয়া তথ্যে উল্লেখ রয়েছে। মর্গ থেকে  লাশ হস্তান্তরের সময়ও থানার দেওয়া ফরোওয়ার্ডিংয়েও ওসি আড়াই হাজার উপজেলার  ইউএনওর সুপারিশের কথা উল্লেখ করেন।
তবে লাভলু’র দেয়া মোবাইল নম্বরটি লাশ হস্তান্তরের পর থেকেই বন্ধ থাকায় সীমার লাশ কোথায় কবর দেওয়া হয়েছে তা নিশ্চিত করা যায়নি। তদন্ত টিমের সদস্যদের সন্দেহ, দেহ ব্যবসায়ী চক্রটি ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে সীমার লাশ গায়েব করেছে।


লর্ডস ইন হোটেলসহ গুলশানের ১৬টি আবাসিক হোটেল দীর্ঘদিন ধরেই হয়ে পড়েছে ‘মিনি পতিতালয়’। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন গুলশান থানায় এনিয়ে সাধারণ ডাইরি করেও সুফল পাননি। বরং থানায় গিয়ে তাদের নানাভাবে নাজেহাল হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।


কী হচ্ছে এই লর্ডস-ইন হোটেলে? বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি’র অনুসন্ধানী চোখ তুলে এনেছে তার নানা চিত্র।
ধারাবাহিক প্রতিবেদন পড়তে ব্রাউজ করতে থাকুন...বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি।

বাংলাদেশ সময় ২০৪৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।