ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

গফরগাঁও ভূমি অফিসে ‘ওপেন সিক্রেট’ ঘুষবাণিজ্য!

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৫ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৭
গফরগাঁও ভূমি অফিসে ‘ওপেন সিক্রেট’ ঘুষবাণিজ্য! গফরগাঁও উপজেলা ভূমি অফিস। ছবি: বাংলানিউজ

গফরগাঁও (ময়মনসিংহ) থেকে: জমির খাজনা কিংবা নামজারি যা-ই করা হোক, ঘুষের কোনো বিকল্প নেই ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার ভূমি অফিসে। কর্মচারি, দালাল ও কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে এখানে গড়ে উঠেছে বড় আকারের সিণ্ডিকেট। আর এই সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে আছে এখানকার সাধারণ মানুষ। 

অভিযোগ রয়েছে, গফরগাঁও উপজেলা ভূমি অফিসে জমির খারিজ বা নামজারি করতে এলে সহকারী কমিশনার (ভূমি), কানুনগো, সার্ভেয়ার, নায়েব ও পিয়নকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ঘুষ দিতে হয়। গফরগাঁও ভূমি অফিসে অনেকটা প্রকাশ্যেই চলছে এই ঘুষবাণিজ্য।

সময়ের নিয়মে সময় পার হলেও কোনোভাবেই থামছে না এই বেপরোয়া ঘুষবাণিজ্য।  

জানা যায়, মূলত ‘মিষ্টি খাওয়া’র নামে এখানে চলে গ্রামের সাধারণ কৃষক থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সবার পকেট-লুট। জমির পরিমাণ যা-ই হোক, তাদের নির্দিষ্ট করা ফি’তেই কাজ করাতে হয়। এখানে জমির খাজনা প্রদান করতেও খাজনার দিগুণ টাকা প্রদান করতে হয়। অন্যথায় খাজনা গ্রহণ করেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত নায়েব রহমত উল্লাহ্।  

সরকারের বেঁধে দেওয়া রেট অনুযায়ী কোনো জমির খারিজ হয় না এখানে। বরং সরকারি রেটের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকার বিনিময়ে  কাজ করাতে হয়। তবে ক্ষেত্রবিশেষে এই ঘুষের পরিমাণ জমির দামের ৪ ভাগের একভাগে চলে আসে বলে জানান এখানে আসা ভুক্তভোগী মানুষ। মাঝেমধ্যে দু-একজন এদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে সরকারি রেটে কাজ করার দাবি জানলে তাদের উপর চলে অযাচিত হয়রানি। তখন ভূমি অফিস থেকে বলা হয়, ‘জমির এই সমস্যা, এ কাগজ নাই, ঐ কাগজ নাই। ’ ফলে এর চেয়ে খরচাপাতি করে তাড়াতাড়ি খারিজ করে নেওয়াই ভালো বলে মনে করেন এখানে আসা মানুষজন।

ভুক্তভোগীরা জানান, বৈধ জমির বৈধ কাগজ নিয়ে গিয়েও প্রকৃত মালিকদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয় গফরগাঁও ভূমি অফিসে। অসাধু সিন্ডিকেটকে ‘ম্যানেজ’ করে খারিজ পার করতে হয়। জমির মালিকরা সরকারী নিয়মের বাইরে গিয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকার বিনিময়ে জমি খারিজ করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। অফিসের দালাল ও কর্মচারী থেকে শুরু করে সবাই শুধু টাকা চায়। টাকা দাও, কাজ হবে নাহলে ঘুরতে ঘুরতে জীবন পার হবে কিন্তু জমির কাজ আর হবে না! 

বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় এই ভূমি অফিসের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কর্মকর্তা, কর্মচারী, দালাল সবাই ঘুষ খাচ্ছেন সবার চোখের সামনেই।

সালটিয়া ইউনিয়নের পুখুরিয়া গ্রামের কৃষক সিদ্দিকুর রহমান বাংলানিউজের কাছে অভিযোগ করে বলেন, ‘গত বৈশাখ মাস থেকে আমার এক টুকরো জমির খারিজের জন্য এই ভূমি অফিসের বারান্দায় ঘুরছি। তাদের চাহিদামত প্রত্যাশিত ঘুষ দিতে না পারায় আমার জমির খারিজ হচ্ছে না। আমার টাকা থাকলে এদের এই গঞ্জনা সহ্য করার চেয়ে টাকা দিয়েই করিয়ে নিতাম। কিন্তু আমি অসহায়, তবুও ছাড় পাচ্ছি না’—একথা বলে কেঁদে ফেলেন তিনি।  

ফজলুর রহমান নামের একজন বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানে টাকা ছাড়া কোনো কাজ করানো সম্ভব না। আমি আমার ২৭ শতাংশ জমির নতুন খারিজ করতে এ পর্যন্ত ২০ হাজার টাকা দিয়েছি এখানে কাজ করা এক কর্মচারীকে। এরপরেও আরো টাকা চায়। কাজ করাতে হলে তাদের কথামত টাকা দিতেই হবে, এদের কাছে জিম্মি সবাই। ’
শুধু এরাই নন, প্রতিদিন কৃষক থেকে শুরু করে অনেক শিক্ষিত মানুষও নাকানিচুবানি খাচ্ছেন এখানে। অভিযোগ করলে উল্টো তাদের নাজেহাল হতে হয় ভূমি অফিসের কর্তা ব্যক্তিদের হাতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ভূমি অফিসের কর্মকর্তা ছাড়াও এখানে রয়েছে বেশ কিছু সিণ্ডিকেট। এর মধ্যে পৌর শহরে ভূমি অফিসের রয়েছে একটি দালাল সিন্ডিকেট। এই দালাল সিন্ডিকেটের মাধ্যম ছাড়া পৌর এলাকার জমির খারিজ হয় না। এ অফিসের পিয়ন থেকে শুরু করে সবাই এ কাজের সাথে যুক্ত। টাকা যত বেশি কাজ তত দ্রুত নিষ্পত্তি সম্ভব এই অফিসে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ভূমি অফিসের এক কর্মচারী বাংলানিউজকে বলেন, ‘এখানকার সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী ঘুষ নিয়ে কাজ করেন। অনেকেই নিজের চাহিদা ও পছন্দ অনুযায়ী নিজ কাজের সুবিধার্থে লোক রেখে নিয়েছেন। যারা তার কথামত টাকার বিষয়টা হ্যান্ডেল করেন। এ অফিসে সবচেয়ে বেশি টাকা নেন কানুনগো, নায়েব, আর এসি ল্যান্ড স্যার। ’

তিনি আরো বলেন, পত্রিকায় লেখলে বা অভিযোগ করে কোনও লাভ নেই। এ অফিসের কর্মকর্তাদের ভূমি অফিস সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন সব জায়গা ম্যানেজ করে রাখেন ফলে আর যাই হোক এই অফিসে কাজ করা কারো কোনো সমস্যাই হয় না শুধু শুধু আপনার সময় নষ্ট হবে!’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে কানুনগো গোলাম মোস্তফা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
অন্যদিকে উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি)শেখ শামছুল আরেফিন বাংলানিউজকে বলেন, ‘ভূমি অফিসে কোনো ধরনের ঘুষ বাণিজ্য, সিন্ডিকেট বা দালালের দৌরাত্ম্য নেই। তবে বাজার, স্টেশন বা রেজিস্ট্রি অফিসে দালাল থাকতে পারে। কিন্তু সেটা দেখা তো আমার কাজ নয়। তার কাছে কেউ কোনোদিন কোনো অভিযোগ দেননি। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪৩ ঘণ্টা, জুন ২৯, ২০১৭
ডিআর/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad