ঢাকা: ডেটলাইন: বৃহস্পতিবার, দুপুর সাড়ে ১২টা। স্থান: ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের মূল ফটকের সামনে।
এক হাজার কয়েদিকে মুক্তির সরকারি সিদ্ধান্তে বৃহস্পতিবার ছাড়া পান তারা। দুপুরে দেশের ৬১টি কারাগারে শুরু হয় মুক্তির এই প্রক্রিয়া।
রুহুল আমিন সর্দারের যখন যাবজ্জীবন সাজা হয় তখন তার সন্তানের বয়স ছিল মাত্র দুই বছর । নাম রেখেছিলেন মো. রোমান। সেই রোমান এখন ২৫ বছরের যুবক। তার বাবার চেহারায় আগের সেই মসৃণতা নেই। ছোটবেলায় দেখা তার টগবগে বাবা এখন বুড়িয়ে গেছেন। রোমান জেলগেটে এসেছিলেন তার বাবাকে নিতে। বাবাকে কাছে না পাওয়ার বেদনা দীর্ঘকাল গুমরে মরেছে তার মনে।
সেই বাবাকে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই আকুল হয়ে ছুটে গেলেন রোমান। বাঁধভাঙ্গা আবেগে আর পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলেন তারা একে অপরকে। দু’জনের চোখেই তখন অশ্রু। বাবা-ছেলের এই মিলন-দৃৃশ্য দেখে অন্যদেরও চোখ ভিজে উঠলো। না ভিজে কি পারে?
‘বাবাটা কতো বুড়িয়ে গেছে। অথচ ছেলেবেলা থেকে কখনও বাবার আদর পাইনি। চাচাদের স্নেহ-ভালবাসা সেটাও কপালে জোটেনি। আজ তাদের কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগছে’, চোখ মুছতে মুছতে বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে রোমান যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন পেছনে তার বাবাও কাঁদছেন। কান্না সংক্রমিত হয়ে গেছে আশেপাশের বাদবাকি দর্শনার্থীদের মধ্যেও।
নাজিমউদ্দিন রোডের এই কারাগারের সামনে বৃহস্পতিবার এমন আবেগঘন দৃশ্যের অবতারণা হয়েছে একের পর এক।
এর আগে সকাল থেকেই কারাফটকের সামনে অধীর আগ্রহে জমেছিল স্বজনদের ভিড়।
সময় হওয়ার পর একেক দফায় ২৫ জন করে তিন দফায় ৭৫ জন বন্দি মুক্তি পান। পা ফেললেন কারাপ্রাচীরের বেষ্টনীর ভেতর থেকে বিশাল মুক্ত পৃথিবীতে ---স্বজন পরিজনঘেরা নতুন জীবনে।
স্বজনরাও আপন মানুষটিকে কাছে পেয়ে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। মুক্তি পাওয়া কয়েদিরাও আপ্লুত হয়েছে প্রিয়জন-সান্নিধ্যে। তাদের কথাবার্তায়ও ছিল আবেগ আর নম্রতা। প্রত্যেকেই হাসিমুখে কথা বলেছেন সাংবাদিকদের সঙ্গে, জবাব দিয়েছেন তাদের করা নানা প্রশ্নের।
রুহুল আমিন সর্দার বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, ‘খুব ভালো লাগছে। দীর্ঘ ২৩ বছরের বন্দিজীবন শেষ হলো আজ। বাইরে বের হতে পেরে আমার কেমন ভাল যে লাগছে তা বোঝাতে পারবো না। ’
‘কারাগার হলো সংশোধনের জায়গা। এখানে থাকার পরও যে নিজেকে সংশোধন করতে না পারবে সে অমানুষই থেকে যাবে’, বললেন তিনি।
টাঙ্গাইলের মধুপুর থানার ইদিলপুর গ্রামের আব্দুল বাকের (৪৯)। ১৯৯২ সাল থেকে সাজা ভোগ শুরু হয় তার। তারই বন্ধু নাসিরুদ্দিন হত্যামামলায় যাবজ্জীবন হয়েছিল তার।
বাকের বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান, কারামুক্ত হয়ে তিনি নতুন জীবন ফিরে পেয়েছেন। বাকি জীবনটা তিনি কাটাতে চান খুন-সংঘর্ষ-মারামারি পরিহার করে। সৎ পথে চলার ব্যাপারে সবার দোয়াও চাইলেন।
একটি হত্যা মামলায় ঢাকার ৩৫ নং নবেন্দ্রনাথ বসাক লেন, বংশাল, নবাবপুরের বাসিন্দা মাহমুদুল ইসলাম রতনের সাজা হয়েছিল ৬০ বছর।
মাহমুদুল ইসলামও বললেন, কারাগার হলো সংশোধনের জায়গা। এখান থেকে বের হয়ে অন্য দশজন মানুষের মতো সহজ নির্ভেজাল জীবন শুরু করবেন তিনি।
‘এখন কি করবেন?’---প্রশ্ন করতেই বলেন, ‘পুরান ঢাকায় পরিবারের ব্যবসা আছে। এখন-সেই ব্যবসা দেখাশোনা করবো। ’
শুধু রুহুল, বাকের বা মাহমুদুল নন, মুক্তি পাওয়া প্রায় সবার মুখেই শোনা গেছে সৎ পথে চলার অঙ্গীকার। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন।
কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আশরাফুল ইসলাম খান জানান, প্রত্যেক বন্দির মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা করে তবেই তাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘২০ বছরের বেশি কিংবা তার কাছাকাছি যেসব বন্দি কারাভোগ করেছেন, তাদের আচার-আচরণ-ব্যবহার দীঘৃদিন ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এক সময় আমরা বুঝতে পালাম, মুক্তি পেলে সমাজের জন্য তারা ক্ষতির কারণ হবেন না। বরং এরা সমাজকে কিছু না কিছু দিতেও পারবে। বন্দিদের সঙ্গে কথাবার্তায়ও তারই প্রতিফলন পেয়েছি ’
বাংলাদেশ সময়: ১৭৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৯, ২০১০।