ঢাকা, বুধবার, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

কলাগাছের কৃত্রিম ‘স্মৃতির মিনার’!

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
কলাগাছের কৃত্রিম ‘স্মৃতির মিনার’! শহীদ মিনারের সামনে উজ্জীবিত শিশুরা/ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

উজান ঘাগড়া, দাপুনিয়া, ময়মনসিংহ থেকে ফিরে: শহীদ মিনার শুণ্য এক গ্রামের নাম উজান ঘাগড়া। ময়মনসিংহ সদর উপজেলার নিভৃত এক গ্রাম।

একুশে ফেব্রুয়ারির (মঙ্গলবার) সকালকে সামনে রেখে কলাগাছ আর বাকল দিয়ে বানানো হয়েছে কৃত্রিম শহীদ মিনার। নামও দেওয়া হয়েছে ‘স্মৃতির মিনার’।

ভাষা শহীদদের প্রতি ভালবাসার অর্ঘ্য নিবেদন করতেই নিজেদের বাড়ির আঙিনায় কলাগাছে কাগজ মুড়িয়ে প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরি করেছে পাড়ার একদল শিশু-কিশোর। তাদের প্রত্যেকের গড় বয়স ৮ কী ১২ বছর।

মঙ্গলবার (২১ ফেব্রুয়ারি) সকাল ১০ টার দিকে নিজেদের তৈরি এ মিনারেই নগ্ন পায়ে বেদিতে ফুল দিয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানিয়েছে কোমলমতি এ শিশু-কিশোররা।

স্থানীয়রা জানায়, কলাগাছ কৃত্রিম শহীদ মিনার বানানোর এক উপকরণ। অতীতে তারুণ্য যখন রাতারাতি সিদ্ধান্ত নিয়ে শহীদ মিনার গড়তো তখন এর উপকরণ হতো কাঠ অথবা কলাগাছ। কালো কাপড়ে ঘেরা।

এ মিনার বানাতে কোনো কারিগরের প্রয়োজন পড়ে না। আবেগ আর সৃষ্টিকে স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ ঘটায়।

পথ চলতেই পাড়ার এ শিশু-কিশোরদের শহীদ মিনার তৈরির কর্মযজ্ঞ চোখে পড়লো।

সদর উপজেলার দাপুনিয়া উজান ঘাগড়া গ্রামের ৮ থেকে ১২ বছর বয়সী শাকিল, শুভ, শাহরি, মিনু, নুপুর, হিয়া, নিহাল, মারুফ, রায়হান ও সামি বাড়ির উঠানে সকালে কলাগাছ দিয়ে শহীদ মিনার তৈরি করছিলো।

বাংলানিউজের সঙ্গে আলাপকালে তারা জানায়, প্রথমে কলাগাছ কেটে মাটিতে গর্ত করে পোঁতা হয়। নিচের দিকটায় বেদির মতো তৈরি করা হয়েছে।

এ কলাগাছে আবার সাদা কাগজ মুড়ানো হয়েছে। শহীদ মিনারের নিরাপত্তার স্বার্থে আবার চারপাশে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে প্রাচীরের মতো নির্মাণ করা হয়েছে।

সেখানে রশিতে লাল, নীল, হলুদসহ নানা রঙের কাগজ বালি (গাম) দিয়ে আটকানো হয়েছে। প্রায় দু’ঘণ্টা ব্যয়ে অস্থায়ী এ শহীদ মিনার তৈরি করা হয়েছে।

পরে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ফুল তুলে দলবেঁধে তারা শহীদদের স্মৃতিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছে।

শিশুদের চেতনায় শহীদ মিনার ছায়া ফেলে। সেই চেতনায় প্রত্যন্ত গ্রামেও আর কিছু সম্ভব না হলেও কলাগাছ হয়ে ওঠে অস্থায়ী শহীদ মিনারের কাঠামো।

অবশ্য অনেক জায়গাতেই এখন ইট সিমেন্টের গাঁথুনিতে স্থায়ী হয়ে ওঠেছে শহীদ মিনার।

নিজেদের তৈরি শহীদ মিনারে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ শেষে খুদে শাকিল, নুপুর, শুভ ও মিনু জানায়, বাড়ি থেকে অনেক দূরে শহীদ মিনার।

আমাদের মতো এ গ্রামের অনেক শিশু-কিশোর বাড়ির উঠানে শহীদ মিনার তৈরি করেছে। সবাই মিলে একসঙ্গে অমর ভাষা শহীদদের স্মরণে আলাদা তৃপ্তি রয়েছে।

ভাষার জন্য প্রাণ আত্মদানকারী শহীদ জব্বার, রফিক, শফিউরকে মোটেও ভুলেনি ওরা। তারা জানান, পাঠ্যপুস্তকে তাদের সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা রয়েছে।

জাতির এ শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জন্যই আমরা মায়ের ভাষায় কথা বলতে পারছি। আর কৃতি মানব জব্বার তো আমাদের ময়মনসিংহেরই। তার বীরত্বগাঁথা ইতিহাস নিয়ে বাবা-মায়ের কাছে গল্প শুনেছি।

আলাপের সময়েই পাশ থেকেই নুপুর গান ধরলো ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি। ’ কন্ঠ মেলালো সবাই। এ সময় শুভ’র কন্ঠে আরেক কালজয়ী সঙ্গীত ‘আমি বাংলায় গান গাই। ’

শাকিলসহ ছোট্ট এ শিশু-কিশোরদের দেশপ্রেমের চেতনায় মুগ্ধ স্থানীয় হানিফ মিয়া পাশের বাড়ি থেকে নিয়ে এলেন ছোট্ট একটি সাউন্ড বক্স।

অতঃপর সেখানে বাজতে শুরু করলো দেশাত্নবোধক নানা গান। জড়ো হতে থাকলেন সব বয়সী নারী-পুরুষেরাও।

এখানেই আলাপ হলো শিশু রায়হানের মা ঝর্ণা আক্তারের (৪০) সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রতি বছরই ওরা শহীদদের সম্মান জানাতে নিজেরাই শহীদ মিনার তৈরি করে।

ওদের দেশপ্রেমের এ চেতনাবোধ আমাদেরও উজ্জীবিত করেছে। তবে এখানে স্থায়ীভাবে একটি শহীদ মিনার হলে একুশের ভোরেই পুস্পস্তবক অর্পণ করতো সব বয়সী মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০১৭
এমএএএম/ওএইচ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।