ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আগুনে পুড়ছে জীবন সহায় সম্পদ

শরিফুল ইসলাম ও মুরসালিন হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২১৯ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১১
আগুনে পুড়ছে জীবন সহায় সম্পদ

[বছর পাঁচেক আগে মহাখালীর বউবাজার-জামাইবাজার এলাকা আগুনে ভস্মীভূত হয়েছিল। বস্তিবাসী নিজেদের কাছে ফোন নম্বর না থাকায় পার্শ্ববর্তী আকিজপাড়ায় এসে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়ার অনুরোধ করে।

কিন্তু পাড়াময় খুঁজেও পাওয়া যায়নি ফায়ার সার্ভিসের ফোন নম্বর। তিন পর্বের প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব আজ ।   ]

যেসব কারণে অগ্নিকাণ্ড : শহরাঞ্চলে বৈদ্যুতিক গোলযোগ, চুলার আগুন এবং বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরা থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাই বেশি ঘটে। গ্রামাঞ্চলে উত্তপ্ত ছাই, চুলার আগুন এবং খোলা বাতি ব্যবহারের কারণেই বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

এছাড়া বাচ্চাদের আগুন নিয়ে খেলা করা, বিভিন্ন ধরণের ধাতব বা অন্যান্য যন্ত্রাংশের ঘর্ষণ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অগ্নিসংযোগ, হাঙ্গামা ও উচ্ছৃঙ্খল জনতার অগ্নিসংযোগ, ষড়যন্ত্র এবং রহস্যজনক কারণেও কিছু কিছু অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে।

তবে অনুসন্ধানে দেখা গেছে বাংলাদেশে ত্রুটিপূর্ণ বৈদ্যুতিক সঞ্চালন ব্যবস্থার কারণে সৃষ্ট বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকেই শহরাঞ্চলে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়।

বেসরকারি এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১০ সালে দেশে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডগুলোর ৪৩.৮৬ ভাগের সূত্রপাত হয়েছে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে। ২০০৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ৩৯.৪৪ ভাগ। ২০০৮ সালে ছিল ৪৩.২৭ ভাগ।

এছাড়া চুলার আগুন থেকে ২০১০, ২০০৯ ও ২০০৮ সালে যথাক্রমে ২৪.৮৯, ২৫.৬৭ এবং ২৫.৯৮ ভাগ। বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো থেকে ৯.৯৭, ৯.৭৫ এবং ৯.৬৪ ভাগ। উত্তপ্ত ছাই ও জ্বালানি থেকে ৩.৪১, ৩.১৬ ও ৪.১৭ ভাগ এবং আগুন নিয়ে বাচ্চাদের খেলা করার কারণে ২.৪১, ২.৪১ এবং ১.৮৭ ভাগ অগ্নিকান্ড সংঘটিত হয়েছে।

তবে কিছু ক্ষেত্রে শত্রুতাবশত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অগ্নিসংযোগ করা হয়। ২০১০ সালে এই হার ছিল ১.২১ ভাগ, ২০০৯ সালের ১.৭৬ এবং ২০০৮ সালের ১.২৬ ভাগ।

গ্রামাঞ্চলে এখনও অসতর্কভাবে মান্ধাতার আমলের খোলাবাতি এবং কুপির ব্যবহার প্রচলিত আছে। ২০১০ সালে এসব খোলাবাতি থেকে ৫.২৪ ভাগ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হয়। ২০০৯ ও ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৬.২৪ ও ৬.৫২ ভাগ।

সাম্প্রতিক সময়ের যত আগুন : বেগুনবাড়ী বস্তি, এনসিটিবি গুদাম, বসুন্ধরা সিটি এবং বিএসইসি ভবনে আগুনের তাণ্ডব ছিল ভয়াবহ। এর বাইরেও সাম্প্রতিক সময়ে সারাদেশে বেশ কিছু বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গত বছর দেশব্যাপী রাসায়নিক পদার্থ আতঙ্ক অগ্নিকাণ্ডের একটি বড় আলোচনার বিষয় ছিল।

দেশের স্মরণকালের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ঘটে ২০১০ সালে। পুরান ঢাকার নিমতলীতে ৩ জুন রাসায়নিক পদার্থের বিস্ফোরণে মারা ১২৫ জন, আহত হন দুই শতাধিক। একই বছর রাজধানীর ধোলাইপাড় এলাকায় একটি সলিউশন (পেস্টিং) কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন সাতজন এবং রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় মশার কয়েল কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ১০ জন।

২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি কারওয়ানবাজারের বিএসইসি’র বহুতল ভবনটিতে শুরু হয় আগুনের তাণ্ডব। ওইদিনের অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছাই হয় বিপুল পরিমাণ সম্পদ। এনটিভিসহ কয়েকটি মিডিয়া-অফিসও রক্ষা পায়নি আগুনের হাত থেকে। নিহত হন ৪ জন। আহতের সংখ্যা ৬০।

দুবছর পর ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ বিএসইসি ভবনের কাছে পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি কমপ্লেক্সে আবারও বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নিহত হন ৬ জন।

একই বছরের শেষদিকে এনসিটিবি’র গুদামে আগুন লাগে। আগুনে গুদামে রক্ষিত কয়েক কোটি টাকার স্কুল পাঠ্যবই এবং বই ছাপার জন্য রাখা কাগজ পুড়ে যায়। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই তিনটি আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসকে হিমশিম খেতে হয়।

সাম্প্রতিককালে আগুনের লেলিহান শিখার বড় শিকার হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্পের কারখানাগুলো। এসব কারখানায় ঘিঞ্জি পরিবেশে হাজারো কর্মী কর্মরত থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বেশি থাকে। এছাড়া এসব কারখানার অধিকাংশ ভবনেই নেই জরুরি বহির্গমন পথ কিংবা বিকল্প সিঁড়ি। তাই দুর্ঘটনা ঘটলে এসব কারখানায় জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয় ব্যাপক।

দমকল বাহিনী সূত্রে জানা যায়, ১৯৯০-পরবর্তী দেড় দশকে দেশে পোশাক শিল্পের কারখানায় ৩৬টি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ সেক্টরে প্রথম অগ্নিকাণ্ডটি সংঘটিত হয়েছিল ১৯৯০ সালের ডিসেম্বর মাসে, মিরপুর ১০ নম্বর সেকশনের সারাকা গার্মেন্টসে, সেখানে আগুনে পুড়ে ৩২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছিল।

সর্বশেষ গতবছরের ফেব্রুয়ারীতে গাজীপুরে গরীব অ্যান্ড গরীব গার্মেন্টসে আগুনে ২১ জন এবং ডিসেম্বরে আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের গার্মেন্টে অগ্নিকাণ্ডে ২৫ জন প্রাণ হারান।

প্রতিবারই আগুন লাগে, পুড়ে ছাই হয় কোটি কোটি টাকার সম্পদ, প্রাণহানি ঘটে। লাশের মিছিলের সাথে জড়ো হয় শতশত আহত মানুষ। কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই আশ্বাস দেন, অগ্নিনির্বাপণের ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় আবার সবই ভুলে যান।

সাধারণ পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, নভেম্বর হতে জানুয়ারি মাস পর্যন্ত সময়েই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেশি ঘটে। এই সময়কাল কখনো কখনো এপ্রিল মাস পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ফায়ার সার্ভিস সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর এই সময়টিতে গড়ে সারাদেশে প্রায় ১০ হাজার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এসব গবেষণা, তথ্য-উপাত্ত হাতে থাকার পরেও অগ্নিনির্বাপণের জন্য সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না।

অগ্নিকান্ডের বার্ষিক ক্ষয়ক্ষতি : প্রতি বছর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় প্রাণহানিসহ বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় বাংলাদেশ। বরাবরের মতই সরকারি হিসাবে যার যথাযথ প্রতিফলন ঘটে না। ফায়ার সার্ভিস যেসব অগ্নিকাণ্ডের হিসাব রাখে সেই অনুযায়ী তৈরি করা হয় সরকারি পরিসংখ্যান। কিন্তু দুর্গম এলাকাসহ গ্রামগঞ্জে সংঘটিত ছোটখাটো অগ্নিকাণ্ডগুলোর হিসাব সরকারি নথিতে স্থান পায় খুবই কম।

ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে দেশে ৯ হাজার ৩শ ১০টি অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে, ফায়ার সার্ভিসের ৪ কর্মীসহ প্রাণ হারিয়েছে একশ’ ছয়জন। অগ্নিকান্ডের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় দুইশ’ ৩১ কোটি টাকা।

২০০৭ সালে সারাদেশে নয় হাজার একশ’ ৯৬টি অগ্নিকাণ্ডে একশ’ ৩৮ জনের প্রাণহানি ঘটে। অগ্নিকান্ডে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল তিনশ’ নয়কোটি টাকা।

২০০৬ সালে নয় হাজার পাঁচশ’ ৪২টি অগ্নিকাণ্ডে দমকল বাহিনীর এক কর্মীসহ একশ’ পাঁচজনের প্রাণহানি ঘটে। আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল দুইশ’ ৩৯ কোটি টাকা।

উল্লেখ্য, ভয়াবহ এসব অগ্নিকাণ্ডের মধ্যেও দমকল বাহিনীর তৎপরতার কারণে এই বছরগুলোয় ব্যাপক পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হয়। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের তৎপরতায় ২০০৮ সালে প্রায় ছয়শ’ ৮৭ কোটি, ২০০৭ সালে ছয়শ’ ৪২  কোটি, ২০০৬ সালে এক হাজার একশ’ ৫৯ কোটি টাকার সম্পদ আগুনের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয় বলে ফায়ার সার্ভিস সূত্র থেকে দাবি করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad