ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আমি মেরেই যাবো

সাংবাদিকের প্রতি জনপ্রতিনিধির আক্রোশ

আবু মুস্তাফিজ, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১১
সাংবাদিকের প্রতি জনপ্রতিনিধির আক্রোশ

গাংনী থেকে ফিরে: অনুষ্ঠানটি ছিল এক অসহায় বৃদ্ধকে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া প্রসঙ্গে।

এতে উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় ইউএনও মনোয়ার হোসেন, উপজেলা চেয়ারম্যান একেএম শফিকুল আলম, গাংনী পৌর মেয়র আহম্মদ আলী এবং স্কুল কলেজের শিক্ষক ও বেশ কয়েকজন স্হানীয় সাংবাদিক।



বৃদ্ধ রহিম বক্স ছিলেন অনুষ্ঠানের পাদপ্রদীপ। বাঁশের কোটরে জমানো তার চার হাজার টাকা ঘুণে খেয়ে দিলে বাংলানিউজ একটি মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন ছাপে। প্রতিবেদনটি পড়ে দেশ বিদেশের বেশ কিছু অসামান্য মানুষ এগিয়ে আসেন তাকে সহায়তা দিতে।

সেই সহায়তার কিছু টাকা রহিম বক্সের হাতে তুলে দেওয়ার জন্যই মেহেরপুর যাওয়া। অনুষ্ঠান সকাল ১১ টায়, গাংনী উপজেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে। সারা রাতের ধকল সামলে অনুষ্ঠান স্থলে পৌঁছে দেখলাম, একে একে সবাই আসছেন।

বাংলানিউজের স্থানীয় প্রতিনিধি কানন ভাই, পরিচয় করিয়ে দিলেন রহিম বক্সের সঙ্গে। মিষ্টি চেহারার বৃদ্ধ বুকে বুক মিলিয়ে বললেন, বাজান আইছেন? এ রকম পরিস্থিতিতে বিমূঢ় হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।

যাই হোক, অনুষ্ঠান শুরু হলো। একে একে অনেকেই বক্তৃতা করলেন। বক্তৃতার পালা এল গাংনী পৌর মেয়রের। আস্তে ধীরেই বলা শুরু করলেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করেই তার গলা চড়ে গেল। শুরু হলো গালমন্দের তুবড়ি। যাকে গালাগাল করছেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি একজন সাংবাদিক।

মেয়র আহম্মদ আলীর অভিযোগ, ওই সাংবাদিক তার বিরুদ্ধে সম্প্রতি যে প্রতিবেদন লিখেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। সাংবাদিকতার নামে অপসাংবাদিকতা। কিন্তু এসব অভিযোগ করেই ক্ষান্ত হলেন না তিনি। ওই সাংবাদিকের বাপ মা তুলে গালাগাল শুরু করলেন। প্রশ্ন তুললেন তার জন্ম নিয়েও।

সেইসঙ্গে তিনি বলেই ফেললেন, তিনি সবাইকে মেরেই যাবেন (তিনি শুধুই মারেন! শিরোনামে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়)

এরই মধ্যে এক সময়কার বিখ্যাত ফুটবলার এবং দৈনিক ইত্তেফাকের স্থানীয় প্রতিনিধি মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম অল্ডাম তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন অনুষ্ঠানটি আসলে অন্য প্রসঙ্গের। কিন্তু কে শোনে কার কথা?

মেয়র সাহেব বাধা পেয়ে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন। এবার তাই কথা দিয়েই মার শুরু করলেন। উদ্ধার করলেন ওই সাংবাদিকের চৌদ্দ গুষ্টি।

সবাই নীরব নিশ্চুপ হয়ে তার চিৎকার চেঁচামেচি আর অকথ্য গালিগালাজ শুনতে বাধ্য হলেন। এক সময় মেয়র আহম্মদ আলী অবশ্য নিজেই থেমে গেলেন।

অন্যরা দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে মূল প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। আর ঠিক তখনই ফের তেতে উঠলেন মেয়র। তিনি তারস্বরে চিৎকার করে ওই সাংবাদিকের বাবা মাকে নানা কিছু করতে চাইলেন। সেইসঙ্গে সাংবাদিককে ভরা মজলিশে মার দেওয়ার প্রকাশ্য ঘোষণা দিলেন।

অনুষ্ঠান শেষে সবাই চলে গেলে স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে জানতে চাইলাম, ভাই মেয়র সাহেবের ব্যাপারটা কী?

সবাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, উনি এরকমই। সবাইকেই মারেন। এর আগেও প্রচুর মানুষকে তিনি কোনও কারণ ছাড়াই পিটিয়েছেন। সম্প্রতি পিটিয়েছেন এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে। তাই নিয়ে রিপোর্ট করার কারণেই ওই সাংবাদিককে পেটানোর ঘোষণা দিলেন।

একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেউ কোনও প্রতিবাদ করেন না কেন? তারা বললেন, কে প্রতিবাদ করবে? উনি তো সবাইকেই মারেন। এই সেদিন নিজে দাঁড়িয়ে থেকে স্থানীয় বিএনপি দলীয় এমপি এবং জেলা বিএনপির সভাপতি আমজাদ হোসেনকে পিটিয়েছেন নিজের পোষা গুণ্ডা দিয়ে।

তারা বললেন, মেয়রের মার থেকে নারীদেরও রেহাই নাই।

একে একে তারা বেশ কয়েকজনের নামও বলে গেলেন, বিউটি, রেহেনা, সরু বালা।

গা ঘিনঘিনে একটা অনুভূতি হলো। মনে মনে ভাবলাম, এই তাহলে আমাদের জনপ্রতিনিধি? মানুষের ভোটে নির্বাচিত?

কে এই আহম্মদ আলী?

গাংনী পৌরসভার নির্বাচিত মেয়র আহম্মদ আলীর রাজনৈতিক পরিচয় তিনি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা। ছিলেন গাংনী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি।

তবে নিজ দলের মধ্যেও তাকে নিয়ে রয়েছে নানা উষ্মা। রয়েছে ক্ষোভ ও বিরক্তি। তাকে নিয়ে বিব্রত স্থানীয় আওয়ামী লীগও।

কিন্তু তারপরও কীভাবে তিনি একের পর এক গণ্যমান্য ব্যক্তি থেকে সাধারণ মানুষের গায়ে হাত তুলতে পারছেন?

উত্তরে জানা গেল, আহম্মদ আলীর একটি পোষা সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। সেইসঙ্গে চরমপন্থি অধ্যুষিত গাংনীর আন্ডারগ্রাউন্ড রাজনীতির সঙ্গেও রয়েছে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ।

এ অভিযোগে গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আহম্মদ আলীকে সেনাবাহিনী ধরে নিয়ে ব্যাপক নির্যাতনও চালায়। এজন্য তাকে দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল সে সময়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক স্থানীয় শিক্ষক জানান, পূর্ব বাংলা জনযুদ্ধ (লাল পতাকা) নেতা তাজবীর হাসান লিপু ওরফে হাউশের সঙ্গে আহম্মদ আলীর ছিল ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।

হাউশ বিগত চার দলীয় সরকারের আমলে পুলিশের সঙ্গে কথিত বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন।

এর চেয়েও বড় কথা হলো, আহম্মদ আলীর ব্যক্তিগত হিংস্র স্বভাবের কারণেই তিনি যার তার ওপর চড়াও হওয়ার ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন।

আহম্মদ আলীর এই দুর্বৃত্ত স্বভাবকেই গাংনীর সাধারণ মানুষ সবচেয়ে বেশি ভয় পায় বলে জানালেন একাধিক মানুষ।

বাংলাদেশ সময়: ১০৪১ ঘণ্টা, আগস্ট ২১, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।