ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মিরসরাই ট্র্যাজেডির এক মাস : শোকাবহ স্মৃতি আজো তাড়া করছে

রিগান উদ্দিন, মিরসরাই প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৩ ঘণ্টা, আগস্ট ১১, ২০১১
মিরসরাই ট্র্যাজেডির এক মাস : শোকাবহ স্মৃতি আজো তাড়া করছে

মিরসরাই (চট্টগ্রাম): মিরসরাই ট্র্যাজেডির একমাস অতিবাহিত হচ্ছে আজ। গত জুলাই মাসের এ দিনে (১১ জুলাই) খেলা শেষে মিরসরাই স্টেডিয়াম থেকে আবুতোরাব এলাকায় ফেরার পথে পিকআপ খাদে পড়ে ৪১ শিক্ষার্থীসহ মোট ৪২ জন নিহত ও কমপক্ষে ৩০ জন আহত হয়।



একমাস আগের সেই দুঃসহ স্মৃতি, প্রিয়জন হারানোর বেদনায় এখনও শোকে মূহ্যমান এ অঞ্চলের মানুষ। নিহত সন্তানের স্মৃতি মনে করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন মিরসরাইয়ের মায়েরা, পরিবারের শোক সামাল দিতে প্রবাস থেকে ছুটে আসছেন বাবারা। সহপাঠীদের শূন্যতাও যেন স্থানীয় শিক্ষা প্রতষ্ঠিানগুলোতে অপূরণীয় থেকে যাবে চিরকাল।

ডেড লাইন ১১ জুলাই
সময় তখন সকাল সাড়ে ১১টা। কচি-কাঁচা শিক্ষার্থীদের ছোটা-ছুটিতে প্রাণচঞ্চল মিরসরাই স্টেডিয়াম ও আশপাশের এলাকা। ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে স্টেডিয়ামে খেলায় অংশনেওয়া নতুন কুঁড়িদের প্রানচঞ্চল্যতা দেখে হাসি মুখে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বিদায় নিচ্ছে কলেজ রোড ও এর আশ পাশের রাস্তায় চলাচলকারী পথচারীরা।

ঘাতক পিকআপটি তখন মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, পিকআপের পাশে নেই চালক মফিজ। শিক্ষার্থীদের নামিয়ে দিয়ে কোথায় যেন সময় কাটাতে বের হয়েছেন তিনি। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে খেলা শেষ হল। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, খেলোয়াড়-দর্শক সবাই যেন ক্লান্তিতে অবসাদগ্রস্থ। তারই মাঝে জয়ের আনন্দে মেতে ওঠা একদল কিশোর-কিশোরী সবার মনে আনন্দ ছড়িয়ে দিতে হাততালি আর নানা শ্লোগানে মুখরিত করছে চারদিক।

খেলা শেষ এবার বাড়ি ফেরার পালা। শিক্ষকরা ছাত্রীদের নিয়ে সিএনজি যোগে আগে রওনা দিলেন। দর্শক ও খেলোয়াড়রা গাদা-গাদি করে উঠে পড়লেন পিকআপে। মিনি পিকআপ, তাই শিক্ষার্থীরা উঠার পর যেন পিকআপে তিল ধারনের জায়গা নেই।

মিরসরাই থেকে বড়তাকিয়া বাজারে পৌঁছার পর ৮ ছাত্রকে নামিয়ে দিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চললো পিকআপটি। বেলা ১টার দিকে সৈদালী গ্রামের তেতৈইতলা এলাকায় সড়ক থেকে খানিকটা উঁচু ব্রিজে উঠতে গিয়ে বিরাট ঝাকুনিতে লাফিয়ে উঠে পিকআপটি। বিপরীত দিক থেকে কাঠ বোঝাই একটি নসিমনকে (ভটভটি) সাইড কেটে সামনে এগুতে গিয়ে চাকা ফসকে বিকট শব্দে খাদে পড়ে যায় পিকআপটি। উল্টে যাওয়ার সময় রাস্তায় ও খাদের পানিতে লাফিয়ে জীবন বাঁচায় কয়েক শিক্ষার্থী।

তবে পিকআপের ওপরের অংশ নিচের দিকে উল্টে পড়ায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নিচে পাপা পড়ে। পানিতে ডুবে যাওয়া পিকআপ থেকে বের হয়ে পালিয়ে যায় চালক মফিজ।

অল্প সময়ের মাধ্যে আশপাশের এলাকা থেকে ছুটে আসেন স্থানীয়রা। শুরু হয় উদ্ধার কাজ, উদ্ধার কাজে অংশ নেন শিশু-কিশোর এমনকি মহিলারাও। কচুরিপানা সরিয়ে জলে ডুব দিয়ে কাঁদা সরিয়ে একে একে আহত ও নিহত শিক্ষার্থীদের উদ্ধারের পর ধুয়ে রাস্তার উপর লাইন করে রাখেন উদ্ধারকারীরা।

মুহূর্তে দুর্ঘটনার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে ঘটনাস্থলে ছুটে আসা অভিবাভক ও স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে ওঠে এলাকার আকাশ-বাতাস। আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে ভর্তি করানো হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও মাতৃকা হাসপাতালে, গুরুতর আহত অবস্থায় কয়েক শিক্ষার্থীকে পাঠানো হয় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।

নিহত শিক্ষার্থীদের লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়া হলে স্বজনদের বুক ফাটা আর্তনাদে কেঁপে উঠে মিরসরাইয়ের আকাশ-বাতাস। ততক্ষণে দুর্ঘটনা কবলিত পিকআপ ও শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও নৌ-বাহিনীর ডুবুরি দল।

উদ্ধারকারী র‌্যাকার দিয়ে পিকআপটি রাস্তায় তোলার পর ঢোবায় আর কোনও শিক্ষার্থীর লাশ রয়েছে কিনা নৌ-বাহীনির ডুবুরি দল ভাল করে খুঁজে দেখে। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে আনলাইন, প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। সন্ধ্যায় নিহতদের লাশ জানাযার উদ্দেশ্যে একে একে আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে আনা হয়। রাত সাড়ে ৮ টায় নিহতদের গণ-জানাযায় আংশ নেয় সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপি ও প্রশাসদের উদ্ধতন কর্মকর্তারা। জানাজা শেষে নিহত মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিয়ে যাওয়া হয় পারিবারিক কবরস্থানে আর হিন্দুদের শশ্মান ঘাটে।

পরবর্তীতের নিহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাতে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ বিভিন্ন দলীয় প্রধান ও সহৃদয়বান ব্যাক্তিরা।

মিররসাইয়ের আবুতোরাব-মায়ানী এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গত ১১ জুলাই দুর্ঘটনার পর এক মাস অতিবাহিত হলেও মিরসরাইবাসীর সেই উদ্ধেগ-উৎকন্ঠার শেষ হয়নি। নিহত কলেজ ছাত্র ইফতেখার উদ্দিনের মা রোকেয়া বেগম জানান, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে ইফতেখার প্রায় সবকটি রোজা রাখতো। কিন্তু এই রোজার মাসে ইফতেখারের শূন্যতায় হাহাকার করছে অধ্যক্ষ বাড়ির চারদিক।

তাই ছেলের রুহের মাগফেরাত কামনা করে রোজা রেখে আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছেন তিনি। এসব বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রোকেয়া বেগম ও ছোট তিন বোন।

আবুতোরাব মাদ্রাসার নিহত শিক্ষার্থী সাইদুল ইসলামের বাড়িতে গেলে, তার মাকে অনেকটা বাকরুদ্ধ অবস্থায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়। ফুফাতো বোন তসলিমা আক্তার বলেন, সাইদুলের মৃত্যুর পর তার মাও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
নিহত কাজল নাথের বাড়িতে গেলে ছোট ভাই নয়ন ও সজল নাথকে বাড়ির সামনে মন্দিরের দরজায় হতাশ হয়ে বসে দেখা থাকতে দেখা যায়। মা অনীতা নাথ রান্না ঘরে চুলার ওপর হাড়ি-তরকারি দিয়ে ছেলের শোকে কান্নায় বুক ভাসাচ্ছেন।

নিহত মেধাবী শিক্ষার্থী ধ্রুব নাথের বাড়িতে গেলে দেখা হয় মায়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ছেলের ইচ্ছে ছিল বড় হয়ে প্রকৌশলী হবে সে। কিন্তু দুর্ঘটনা আমার ছেলেকে আমার কোল থেকে কেড়ে নিয়েছে। ’

তাই এই দুর্ঘটনায় কারণ উদঘাটন করে চালক মফিজ, পিকআপ মালিক এমরানের ও আবুতোরাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিচালনা বোর্ডের সভাপতি জহির উদ্দিনের কঠোর শাস্তি দাবি করেন তিনি।

উদ্ধারকারী দলের এক নায়ক শিক্ষার্থী অজিত দাশ। ভাগ্যগুনে তিনি বেচে গেলেও উদ্ধার কাজে অংশ নিতে গিয়ে তার মৃত্যুর খবরে হাট অ্যাটাকে নিহত হন বাবা হারাধন দাশ।

অজিত বলে, ‘বাবা আমাকে খুব ভালবাসতেন। তাইতো আমার মৃত্যুর ভুল খবর শুনে তিনি মারা যান। সবাই হারিয়েছে তাদের সন্তানদের কিন্তু আমার মৃত্যুর খবর শুনে আমার বাবা মারা গেলেও আমি বেচে যাই। বাবাকে নিয়ে ঈশ্বর কেন যে আমাকে বাচিয়ে রাখলো !’ এসব বলতে বলতে কান্নায় স্তব্দ হয়ে আসে অজিতের।  

শুধু ইফতেখার, সাইদুল, কাজল কিংবা ধ্রুব নয় নিহত সকল শিক্ষার্থী এমনকি মিরসরাইয়ের প্রতিটি ঘরে আজো শোকের মাতম চলছে। মাস অতিবাহিত হলেও বিভিষীকাময় সেই মূহুর্তের কথা ভুলতে পারছেনা এই জনপদের প্রতিটি মানুষ এমনটি শিশুরাও। তাইতো ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে দুর্ঘটনার স্পট সেই খাদের পাড়ে কৌতুহলী মানুষের আজো ভিড় কমেনি।

আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু জাফর সাদেক বাংলানিউজে জানান, দুর্ঘটনায় আবুতোরাব উচ্চ বিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ৩২ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়। তাই মেধাবীদের হারিয়ে এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের শোকের মাত্রাও খানিকটা বেশি। গত ২৯ দিনে সেই শোক শিক্ষকদের মাঝে কিছুটা ছাপা পড়লেও বিশেষত ছাত্রীদের নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। তাইতো বন্ধের দিনেও বিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছুটে আসছে শিক্ষার্থীরা।

মায়ানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কবির নিজামী ও মঘাদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শাহিনুল কাদের চৌধুরী বাংলানিউজকে জানান, স্মরণকালের বয়াবহ দুর্ঘটনার পর মাস অতিবাহিত হলেও আজো শোক তাড়া করছে এ অঞ্চলের মানুষকে। তাই নিয়মিত নিহতদের পরিবারের খবর নেওয়ার পাশাপাশি আহতদের খোঁজ নিচ্ছেন বলেও জানান এ দুই চেয়ারম্যান।

মিরসরাই উপজেলা চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন ও ভাইস চেয়ারম্যান ফেরদৌস হোসেন আরিফ বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিরসরাই ট্র্র্যাজেডির গত এক মাসেও মিরসরাইবাসীর শোক সাগরে ভাটা পড়েনি। এবারের ঈদের আনন্দেও হয়তো বিষাদের ছায়া হয়ে থাকবে ১১ জুলাইয়ের স্মৃতি।

তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি এক মাসেও। এদিকে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় কর্তৃক গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির রিপোর্ট এক সপ্তাহের মধ্যে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দুই দফায় সময় বাড়ানো পর গত এক মাসেও পূর্নাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।

গত ৩ আগষ্ট তদন্ত কমিটির প্রধানও চট্টগ্রাম সওজ বিভাগের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ইবনে আলম হাসান বাংলানিউজকে বলেন, দুর্ঘটনার সঠিক কারণ উদঘাটন করতে মাঠ পর্যায়ে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সকল তথ্য ইতমধ্যে সংগ্রহ করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সংগ্রহীত তথ্য বিচার-বিশ্লেষন করে আগামী ১১ আগস্টের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট যোগাযোগ মন্ত্রনালয়ে জমা দেওয়া হবে বলে জানালেও বৃহস্পতিবার  যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে আরো কয়েকদিন সময় লাগতে পারে।

দুই দফায় সময় বাড়িয়েও তদন্ত রির্পোট জমা দিতে দেরি হওয়ার কারন জানতে চাইলে তিনি বলেন, মিরসরাই ট্র্যাজেডি ইতিহাসের একটি আলোচিত দুর্ঘটনা। তাই সকল বিষয় ভাল করে নিরীক্ষণ করতে অধিক সময় ব্যায় হচ্ছে। এছাড়া কোনও তদন্ত রিপোর্ট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা দেওয়া সম্ভব হয়না বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মিরসরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ইফতেখার হাসান চৌধুরী ও দুর্ঘটনা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ওসি (তদন্ত) অংসা থোয়াই বাংলানিউজকে বলেন, ‘দুর্ঘটনার ঘটনায় একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এবং তদন্ত শেষে ওই মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৯১৩ ঘণ্টা, ১১ আগস্ট, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।