ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

আহা, বিরিয়ানি!

মনোয়ারুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬০৪ ঘণ্টা, আগস্ট ৯, ২০১১
আহা, বিরিয়ানি!

ঢাকা: ‘বিরিয়ানির স্বাদ আর ঐতিহ্য নিয়ে গল্পের শেষ নেই। পুরান ঢাকার বিরিয়ানি মোগল আমল থেকেই জনপ্রিয়।

’ জানালেন ঢাকা গবেষক ও ইতিহাসবেত্তা মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও ছোটবেলা থেকেই নানা ধরনের বিরিয়ানি খেয়েছি। ঢাকার খাবারের ইতিহাসে বিরিয়ানির নাম সবার আগে আসে। ’

পুরান ঢাকা মানেই যেন জিভে জল এসে যাওয়ার মতো সব খাবার-দাবার। স্বাদে ও গন্ধে কোনোটিই কোনোটির চেয়ে কম নয়।

পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোড দিয়ে আসা-যাওয়ার সময় দেখা যায় সকাল থেকে গভীর রাত অব্দি বিরিয়ানির দোকানগুলোয় ভিড় লেগেইআছে। আর ভিড়ের কারণ জানতে ভিড় ঠেলে সামনে যাবার প্রয়োজন নেই। দোকানগুলোর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই সুগন্ধি সুস্বাদু বিরিয়ানির ঘ্রাণ পাওয়া যায়। আর সেই "ঘ্রাণ" পুরনো ঢাকার অনেক মুখরোচক খাবারের একটি বৈশিষ্ট্য। পুরান ঢাকার মানুষের হাজারো খাবার তালিকায় বিরিয়ানি খাবারটি প্রথম সারিতেই রয়েছে। তাই এর চাহিদা সব প্রজন্মের কাছেই সমান।

আলাউদ্দিন রাডের মিষ্টির দোকানদার হাজী তোরাব আলী জানালেন, ৪০ বছর ধরে তিনি হাজির বিরিয়ানির দোকান দেখছেন। শুরু থেকেই স্থানীয় মানুষেরা সকালের নাশতা করতেন হাজির বিরিয়ানি দিয়ে। এখনো সেই ধারা অব্যাহত আছে।

পুরান ঢাকার আলাউদ্দিন রোডে হাজীর বিরিয়ানি অত্যন্ত সুনামের সাথেই ব্যবসা করে চলছে। ১৯৩৯ সালে হাজী গোলাম হোসেন প্রথম হাজীর বিরিয়ানির দোকানটি শুরু করলেও বর্তমানে ব্যবসার পুরো দেখভাল করছেন তার নাতি হাজী মোহাম্মদ সাহেদ।

এক ডেকচি বিরিয়ানি নিয়ে হাজি মোহাম্মদ হোসেন বিরিয়ানির দোকান দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর ছেলে হাজি গোলাম হোসেন বাবার ব্যবসাকে আরও বড় করেন। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হাজির বিরিয়ানির নাম। তাঁদের মৃত্যুর পর এই ব্যবসার দায়িত্ব তুলে নেন হাজি গোলাম হোসেনের ছেলে হাজি শাহেদ হোসেন।

একটি ডেকচি নিয়ে যেই হাজির বিরিয়ানির যাত্রা শুরু, সেই হাজির বিরিয়ানি এখন পুরান ঢাকা, মতিঝিল বিমানঅফিস ও বসুন্ধরায় আবাসিক এলাকায় তিনটি দোকান নিয়ে চলছে।

হাজি শাহেদ বললেন, এক জায়গায় হাজির বিরিয়ানি তৈরি হয়, তারপর সব স্থানে তা সরবরাহ করা হয়। পুরান ঢাকার দোকানে বিরিয়ানি পাওয়া যায় সকাল ছয়টা থেকে আটটা পর্যন্ত। এরপর সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত নয়টা। মতিঝিলের বিমান অফিসের কাছে যে দোকানটি, তাতে পাওয়া যায় দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত। বারিধারায় পাওয়া যায় দুপুর ১২টা থেকে বেলা তিনটা পর্যন্ত।

তিনি বলেন, তিনটি দোকানেই প্রতিদিন প্রচুর মানুষ বিরিয়ানি খেতে আসেন। তিনটি দোকানের জন্য মোট ছয় ডেকচি বিরিয়ানি রান্না করা হয়। ছয় ডেকচির বেশি রান্না করা সম্ভব হয় না। যাঁরা আগে আসেন, তাঁরাই আগে বিরিয়ানি নিতে পারেন।

হাজীর বিরিয়ানির বিশেষত্ব হচ্ছে বিরিয়ানি রান্নায় ঘি/বাটার অয়েল এর পরিবর্তে শুধু সরিষার তেলের ব্যবহার। বর্তমানে হাজীর বিরিয়ানির প্রতি প্লেট ১৩০ টাকা।


হাজির বিরিয়ানি তৈরির প্রথম বাবুর্চি ছিলেন হাজি মোহাম্মদ হোসেন। ছয় বছর বয়স থেকে তাঁর সঙ্গে আছেন হাজি কালাম। মোহাম্মদ হোসেনের কাছ থেকে তাঁর ছেলে গোলাম হোসেন যেমন রান্নাটা শিখেছিলেন, তেমনি শিখে নিয়েছিলেন কালাম। এখন তিনিই বাবুর্চি। বয়স হয়েছে অনেক।

ভবিষ্যতে হাজির বিরিয়ানি কতদিন থাকবে এ প্রশ্নের উত্তরে হাজি শাহেদ জানালেন, বর্তমান বাবুর্চি কালাম মিয়া যখন থাকবেন না, তখন তার সহকারীরা এই রান্না করবেন। এরই মধ্যে কালামের সঙ্গে থেকে অনেকেই এই রান্না রপ্ত করে ফেলেছেন।

হাজীর বিরিয়ানির পাশেই রয়েছে হানিফের বিরিয়ানি। এ বিরিয়ানি হাউজটিও বেশ পরিচিত পেয়েছে।

মিরপুরের ব্যবসায়ী রাকিব হোসেন সপ্তাহে প্রায় দিনই দুপুরের খাবারটি এখান থেকেই সেরে নেন বলে জানালেন। রাকিব বলেন, মাঝে মাঝে মধ্যে বিরিয়ানি কিনে আমার অফিসে আড্ডা এবং মজা করে সবাই মিলে খাই। প্রতি প্লেট ১১০ টাকা হলেও খাবারের মান অনেক ভাল।

আলাউদ্দিন রোডেরই বিউটি বিরিয়ানি হাউজ অনেকের পছন্দের তালিকায় প্রথম। এখানে সকাল সন্ধ্যায় ভিড়ের কমতি নেই।

চাঁনখার পুল এলাকায় মামুন বিরিয়ানি হাউজে রাত ১২ টার পরও ভিড় কমে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট ও মেডিক্যালের শিকাক্ষার্থীরাই প্রধান ক্রেতা।

১৯৬২-৬৩ সালের দিকে পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে বিরিয়ানি দিয়েই এখানকার মানুষের দৃষ্টি কাড়েন বাবুর্চি নান্না মিয়া।

সে আমলে মাত্র দেড় টাকায় এক প্লেট পোলাও এবং আস্ত একটা মুরগিসহ শাহি মোরগ পোলাও উপভোগ করেছে মানুষ।

তখন মোরগ পোলাওয়ের সঙ্গে কোনো ঝোল দেওয়া হতো না। শুধু পোলাও এবং রোস্টের সঙ্গে যে ঝোলটুকু থাকত আর যে মিষ্টি সুগন্ধ বের হতো, তাতেই মানুষের মুখে স্বাদ লেগে থাকত বহু দিন।

বাবুর্চি নান্না মিয়া রান্না করতেন আর ছোট্ট একটি ঘরে মাটিতে চাটাই পেতে খেতে হতো সবাইকে। সময় গড়িয়েছে, চাটাইয়ের বদলে এসেছে  চেয়ার-টেবিল, খাবারের স্বাদেও এসেছে নতুনত্ব। এখন প্রতি প্লেটের দাম ১২০ টাকা।

নয়াবাজারে জনপ্রিয় খালেক বিরিয়ানি। দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে একই জায়গায় ও এক দামে বিক্রি করায় অনেকেরই পছন্দের তালিকায় খালেকের বিরিয়ানি।

পুরান ঢাকার আর এক জনপ্রিয় হোটেলের নাম স্টার হোটেল। এখানে অবশ্য সব ধরনের খাবারই বিক্রি হয়। কিন্তু স্টার হোটেলের অনেক খাবারের মধ্যে এখানকার কাচ্চি বিরিয়ানির চাহিদা এলাকার লোকজনের মধ্যে খুব বেশি। এখানে কাচ্চি বিরিয়ানির প্রতি প্লেট ১২০ টাকা।

আলাউদ্দিন রোডে রয়েছে ভাই ভাই বিরিয়ানি হাউজ, মক্কা-মদিনা বিরিয়ানি হাউজ, বিসমিল্লাহ বিরিয়ানি হাউজ। পুরান ঢাকায় আরও নতুন কিছু বিরিয়ানি হাউজ রয়েছে। সেখানে প্রতি প্লেট ৯০ টাকা থেকে শুরু করে ১৩০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়।

এছাড়াও পুরাতন ঢাকার জিন্দাবাহার এলাকায় করিম মিয়ার মোরগ পোলাও প্রতি প্লেট ৯০ টাকা।

নারিন্দার ঝুনু মিয়ার কাচ্চি বিরিয়ানি ১০০ টাকা।  

মালিটোলার ভুলুর বিরিয়ানি, সুরিটোলায় রহিম বিরিয়ানি,কলতা বাজারের মোল্লা বিরিয়ানি, নারিন্দা রয়েল কাচ্চি বিরিয়ানি, নবাবপুরের স্টার হোটেলে কাচ্চি বিরিয়ানি, নর্থ সাউথ রোডে আল রাজ্জাক হোটেলের কাচ্চি বিরিয়ানি।  

পুরনো ঢাকার এসব বিরিয়ানি হাউজ ছাড়াও ইসলামপুর, বাবুবাজার, সাজিরা বাজার, চকবাজারে বেশ কয়েকটি অভিজাত বিরিয়ানির দোকান রয়েছে।

পুরনো ঢাকার খাবার তালিকায় বিরিয়ানি হবার অনেক কারণও রয়েছে।   ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকা শহরের সবচেয়ে দামি এলাকা ছিল ঢাকার গেয়ান্ডারিয়া, ওয়ারি, নাজিরা বাজার, লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকা। আর সেখানে বসবাস করতো ভারতবর্ষের নানা স্থানের লোকজন। তেমনি ছিল মোগলরা।

বিভিন্ন মুখরোচক খাবারের প্রতি তাদের ছিল দুর্বলতা। অনেকটা সেখান থেকেই পুরাতন ঢাকার মানুষদের মুখরোচক খাবারের প্রত রয়েছে আকর্ষণ। আর বিরিয়ানি তাদের মধ্যে অন্যতম। সেই ঐতিহ্য পুরনো ঢাকাবাসী আজও ধরে রেখেছে। যত দিন যাচ্ছে এসব এলাকার এখানে ওখানে মাথা তুলছে একর পর এক বিরিয়ানির দোকান।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৫ ঘন্টা, আগস্ট ০৯, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।