ঢাকা, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে অজ্ঞাত লাশ বানাতে চেয়েছিল: আজমেরী

সাঈদুর রহমান রিমন/ আজিজুল হাকিম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১০, ২০১০
ওরা আমাকে আগুনে পুড়িয়ে অজ্ঞাত লাশ বানাতে চেয়েছিল: আজমেরী

ঢাকা : স্বামীর প্রস্তাবে দেহ ব্যবসা চালাতে রাজি না হওয়ায় ও ‘ভারতীয় ক্রেতার’ কাছ থেকে পালিয়ে আসার অপরাধেই(!) আজমেরী বেগম (২৫) কে বর্বরতার শিকার হতে হয়েছে। ভারতে নারী পাচার ও তাদের দেহ ব্যবসায় বাধ্য করার কাহিনী ও  ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় আজমেরী বেগমের মুখ চিরতরে বন্ধ করার ফন্দি এঁটেছিল আজমেরীর স্বামী রুবেল ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা।


আজমেরী জানান, শুধু হত্যা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল না, হত্যার পর আগুনে পুড়িয়ে চেহারা বিকৃতি ঘটিয়ে ‘অজ্ঞাত লাশ’ বানাতে চেয়েছিল ওই চক্র। এ কারণেই ডিজেল ও কেরোসিন ঢেলে তার সারাদেহ ভেঁজানো হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনের সামনে দায়িত্ব পালনকারী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের তৎপরতায় সৌভাগ্যবশত বেঁচে যান আজমেরী বেগম। শেরেবাংলানগর থানা পুলিশ আজমেরী বেগমকে উদ্ধার করে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করে পরে সোমবার রাত ১০ টায় সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।


ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আজমেরী বেগম মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে এসব কথা জানিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে রাত সাড়ে ৮টা পর্যন্ত তার উপর চালানো নির্মম নির্যাতনের কথা মনে করে আজমেরী বেগম বার বার শিউরে ওঠেন, দু’দফা সম্বিত হারিয়ে ফেলেন।


আজমেরী বেগম জানান, শরীয়তপুরের লাকার্তায় তার গ্রামের বাড়ি। বাবা হাবিবুর রহমান শিকদার মারা গেছেন। চার ভাই দুই বোনের মধ্যে তিনিই সবার বড়। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারে কিছুটা অর্থের যোগান দিতে আজমেরী ২০০২ সালে সৌদি আরব যান এবং সেখানে একটি হাসপাতালে কিনার পদে ৬ বছর চাকরি করেন। ২০০৮ সালের এপ্রিলে তিনি দেশে ফিরে আসেন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ওয়াটার ওয়ার্কস রোডের ৯৩ নম্বর বাড়িতে বসবাসকালেই আজমেরী বেগমের পরিচয় হয় মোঃ রুবেল আহমেদ নামে এক যুবকের। রুবেলের বাবা মৃত ইউসুফ আহমেদ, কামরাঙ্গীরচর থানার ছাতা মসজিদ সংলগ্ন এইচ/২ নম্বর বাড়িটি তাদের। নিজেকে মার্জিত ভদ্রলোক ও রেন্ট-এ-কারের ব্যবসায়ী পরিচয় দিয়ে তিনি আজমেরীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন রুবেল এবং একপর্যায়ে তাদের বিয়ে হয়।


আজমেরী অভিযোগ করে জানান, বিয়ের পরপরই রুবেল তার রেন্ট-এ-কারের ব্যবসা আরো বড় করার জন্য আজমেরীর জমিয়ে রাখা ৬ লাখ টাকা ও ৭ ভরি স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেন। বিয়ের পর থেকেই নগরীর হাজারীবাগ, চকবাজার, শ্যামপুর, ঝাউচর মহল্লায় বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করতেন রুবেল-আজমেরী। কিন্তু ঘন ঘন বাসা পাল্টানোসহ নানা কর্মকান্ডে স্বামী রুবেলের প্রতি আজমেরীর সন্দেহ হয়। খোঁজ খবর নিয়ে তিনি জানতে পারেন, রুবেল আরো ৬টি বিয়ে করেছে-আজমেরী তার ৫ম স্ত্রী। তখন থেকেই তাদের মধ্যে কিছুটা ঝগড়া-ঝাটি চলতে থাকলেও রুবেল মোটেও তা পাত্তা দেননি।


ভারতীয় হরিদাসের কাছে নারী পাচার : আজমেরী বেগম আরো জানান, বিয়ের এক বছরের মাথায় রুবেল বিভিন্ন বাসায় তাকে অনৈতিক কাজে লিপ্ত করার চেষ্টা করে। কিন্তু এতে ব্যর্থ হয়ে রুবেল তার গোপন ব্যবসার পার্টনার ভারতীয় নাগরিক হরিদাসের কাছে মাত্র ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে আজমেরীকে বিক্রি করে দেন। হরিদাসের বাড়ি কোলকাতার সল্টলেক এলাকায় বলেও জানতে পারেন আজমেরী।


চাকরির প্রলোভন দিয়ে আজমেরীকে নিয়ে ২০০৯ সালের ২২ এপ্রিল কোলকাতার উদ্দেশে রওনা দেওয়ার পরপরই বিষয়টি ঘটনাচক্রে হরিদাস ফাঁস করে দেয়ায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন আজমেরী। কমলাপুর রেলস্টেশনে হরিদাসকে বসিয়ে রেখে পালিয়ে সে যাত্রায় পাচারের হাত থেকে রক্ষা পান আজমেরী।


এর পরের দিন নারী পাচারের অভিযোগ তুলে আজমেরী চকবাজার থানায় লিখিত এজাহার দাখিল করেন। কিন্তু তদন্ত করে মামলা রজ্জুর আশ্বাস দিয়ে তাকে বিদায় করেন ডিউটি অফিসার।


আজমেরী জানান, চাকরির প্রলোভন দিয়ে তার স্বামী রুবেল ও তাদের সহযোগিরা হরিদাস ও জ্ঞানেন্দ্র নামে দুই ভারতীয় নাগরিকের কাছে বিভিন্ন মেয়েকে তুলে দেন। তারা সীমান্ত পথে ভারতে নিয়ে যাওয়ার পর আর কেউ ফিরে আসেনি বলেও দাবি করেন আজমেরী। তিনি জানান, রুবেল তার আগের ৪ স্ত্রীকেও ভারতে পাচার করেছে। বর্তমানে রীতা নামে এক স্ত্রীকে নিয়ে রুবেল মিরপুরের কোনো এক মহল্লায় মেয়ে সংগ্রহের আস্তানা বানিয়েছে।


সোমবার যা ঘটে:  সোমবারের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে আজমেরী বেগম জানান, চকবাজার থানায় বিকেল তিন টায় তিনি রুবেলের বিরুদ্ধে যৌতুক, নির্যাতন ও হুমকি সংক্রান্ত মামলা দায়েরের জন্য যান। কিন্তু অজ্ঞাত মাধ্যমে খবর পেয়ে রুবেল তার ভাই মানিক, মা খোরশেদা বেগম, বোন রুনা বেগম ও আরেক স্ত্রী রীতাকে নিয়ে চকবাজার থানার গেটে যান। সেখানে রুবেলের মা খোরশেদা বেগম বুঝিয়ে শুনিয়ে মামলা করানো থেকে বিরত করেন আজমেরীকে।


এরপর খোরশেদা বেগম পুত্রবধূ আজমেরীকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যাবার কথা বলে তাকে মাইক্রোবাসে তোলার পরই শুরু হয় অত্যাচার-নির্যাতন। আজমেরীর মুখের ভিতরে কাপড়ের অংশ গুঁজে দিয়ে হাত বেধে ফেলা হয়। তারপর নানা কায়দায় চলে বর্বরতা। টেনে টেনে তুলে ফেলা হয় তার মাথার চুল।


একপর্যায়ে রুবেল-রীতার ‘মিরপুর আস্তানা’য় তুলে তারা আজমেরীকে খুন করে লাশ ম্যানহোলের ভেতরে ফেলে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু ওই বাসার নিচতলার পানির লাইনে কাজ চলতে থাকায় সে পরিকল্পনা কাজ করে নি। সন্ধ্যা নামার পরপরই তাকে ডিজেলে চুবিয়ে হাত-মুখ বাধা অবস্থায় রাজধানীর অন্য কোনো নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। এ অবস্থায় গণ ভবনের সামনে মাইক্রোবাসটি বিকল হয়ে পড়ায় রুবেলসহ বাকিরা গাড়ি ধাক্কাতে বাইরে নেমে আসলে হাত-মুখ বাধা অবস্থায় আজমেরী গাড়ি থেকে গড়িয়ে রাস্তায় পড়েন। তখনই সেখানকার নিরাপত্তা-কর্মীরা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করেন। তবে এরই ফাঁকে মাইক্রোবাসটি চালু হলে দ্রুত সটকে পড়েন রুবেল ও তার সঙ্গীরা।


মামলা নিয়ে টানাহেঁচড়া !


হত্যার চেষ্টাকালে পুলিশ উদ্ধার করলেও আজমেরী বেগমের ব্যাপার নিয়ে মঙ্গলবার রাত  পর্যন্ত শেরেবাংলানগর থানায় কোনো মামলা রেকর্ড হয়নি। বরং ঘটনাস্থল নিয়ে শেরেবাংলানগর ও চকবাজার থানার মধ্যে শুরু হয়েছে রশি টানাটানি।


শেরেবাংলানগর থানার অফিসার ইনচার্জ রিয়াজ হোসেন বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডি কে জানান, গণভবনের সামনে থেকে উদ্ধার হওয়ায় এ থানায় আজমেরী উদ্ধার সংক্রান্ত একটি সাধারণ ডাইরি করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আজমেরীকে তার জবানবন্দী অনুযায়ী চকবাজার থানা এলাকা থেকে অপহরণ করার পর হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। ফলে মূল ঘটনাস্থল হিসেবে চকবাজার থানাতেই এ ব্যাপারে মামলা হওয়া উচিত। ’
চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ আলী বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। এখনো কেউ মামলা নিয়ে আসে নি। তাছাড়া শেরেবাংলানগর থানা পুলিশ যেহেতু তাকে উদ্ধার করেছে সেহেতু শেরেবাংলানগর থানাতেই মামলা নিয়ে তদন্ত শুরু করতে হবে। ’


এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আজমেরী বেগমের অভিযোগে বর্ণিত আসামিদের বাড়িঘর কামরাঙ্গীরচর থানায়। ভিকটিম সে থানায় গিয়েও মামলা করলে সুফল পেতে পারেন। ’


অপরদিকে কামরাঙ্গীরচর থানার অফিসার ইনচার্জ শফিকুল ইসলাম বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম.বিডিকে জানান, ‘ঘটনাস্থল ও উদ্ধারের ঘটনা সবই অন্য থানায়- কামরাঙ্গীরচর থানা এ বিষয়ে যুক্ত হওয়ার কোন কারণ নেই। ’


তিনি আরো বলেন, আজমেরী বেগমের বিষয়ে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো তথ্যই পাননি।

বাংলাদেশের স্থানীয় সময় ২১৩৫ ঘন্টা, আগস্ট ১০, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।