ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি থানার ৮৭টি এলাকা ‘পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান’ হিসেবে চিহ্নিত

চট্টগ্রামের ৬ জেলায় পাহাড় ধসের ঝুঁকিতে সাড়ে ৬ লাখ মানুষ

সাঈদুর রহমান রিমন<br>সিনিয়র করসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২১৮ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১০

বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের বৃক্ষহীন ন্যাড়া এবং মাটি কেটে ক্ষত-বিক্ষত করা পাহাড়গুলো আশেপাশে বসকারী লাখ লাখ মানুষের জন্য ’মৃত্যু ফাঁদ’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাঠচোরদের বেপরোয়া তৎপরতায় পাহাড়ি বন উজাড় হচ্ছে আর অব্যাহতভাবে পাহাড় কেটে মাটি চুরি চলতে থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগে পাহাড় ধসের ট্রাজেডি ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকি বেড়ে চলেছে।

নতুন বন সৃজন না করে অপরিণামদর্শী কায়দায় একের পর এক বন উজারের পর এখন বহু ন্যাড়া পাহাড় ধসে পড়ার ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এসব কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ৬ জেলার ১১টি থানা এলাকায় পাহাড় ধসের ঝুঁকির মুখে বসবাস করছে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মানুষ। ভয়াবহ দুর্ঘটনা আর মৃত্যুঝুঁকি মাথায় নিয়ে বছরের পর বছর পার করছে তারা অনেকটা নিয়তি-নির্ভরতার মধ্যে। তবে বর্ষা মৌসুম এলেই প্রমাদ গোণে তারা।   টানা বর্ষণের দিনগুলোতে রাতের ঘুম হারাম হয়ে যায় পাহাড় ধসে জানমালের সর্বনাশের আশংকায়।

পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক ড. শাহজাহান খন্দকার জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি থানার ৮৭টি এলাকাকে ‘পাহাড় ধসের ঝুঁকিপূর্ণ স্থান’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ২০০৯ সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রাম বিভাগীয় দপ্তর থেকে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বরাবরে একটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়।

প্রতিবেদনে কক্সবাজারের উখিয়া, কুতুপালং, হ্নীলা, টেকনাফের বাহারছড়া, মহেশখালীর আদিনাথ মন্দির সংলগ্ন দুটি পাহাড়, সীতাকুণ্ডের বারবকুন্ড, চকোরিয়া-লামা রোডের ৬টি পয়েন্ট, আজিজনগর, রামু, রাঙ্গুনিয়া, চকোরিয়ার মেধাকচ্ছপিয়া, রাঙ্গামাটির বনরূপা, বান্দরবানের বনরূপাপাড়া, কাপ্তাই-রাজস্থলী, বিলাইছড়ি, আলিখিয়্যাং, কবিরাছড়া, ওলুছড়ি, চাইন্দ্যা, বাঁশকাটাছড়া, খুইট্যাছড়ি, তক্তানালা, রাউজানঢালা, চট্টগ্রাম মহানগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন সংলগ্ন মহল্লাসমূহ, টাইগারপাস, পাহাড়তলী রেলওয়ে ওয়ার্কশপ এলাকা, খাগড়াছড়ির রামগড় বাগানপাড়া, গুইমারা ও ছোট হরিণার কয়েকটি পয়েন্ট খুবই ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানানো হয়।

এ ব্যাপারে জানতে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মনোয়ার হোসেনের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি সূত্র জানায়, ডিজি মনোয়ার হোসেনকে অতি সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। এখনো পর্যন্ত কেউ তার স্থলাভিষিক্ত হননি।

২০০৪ সালে প্রণীত বনায়ন নীতিমালা ও পরিবেশ অধ্যাদেশে পাহাড় কাটা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ থাকলেও তা তোয়াক্কা করছে না কেউ। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রেও পরিবেশ অধিদপ্তরের তৎপরতা নেই বললেই চলে। স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (চউক) মহানগরীভুক্ত এলাকায় মাঝে মধ্যে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে অভিযান চালালেও সমগ্র পার্বত্য এলাকায় পাহাড় কাটা চলে বল্গাহীনভাবে।

পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, পাহাড় কেটে বাড়িঘর নির্মাণের প্রবণতা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসলেও ইদানিং এর মাত্রা খুবই বেড়ে গেছে। পাহাড়ের মাঝামাঝি অংশ বিপজ্জনকভাবে খনন করে বাড়ি বানানোর দৃশ্য অহরহ চোখে পড়ে। এভাবে পাহাড় কাটার ফলে পাহাড়ের নিচের অংশ মাটিশূন্য হয়ে পড়ায় চূড়াগুলো সহজেই ধসে পড়ে। অর্থাৎ পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার অনেক পাহাড়ে ধসের জন্য ভারি পাহাড়ি ঢলের প্রয়োজন পড়ে না, বরং সামান্য বৃষ্টিতেই ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়গুলো হুড়মুড় করে ধসে পড়ে। আর ঘন ঘন এমন ঘটনায় জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

এদিকে বন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, ২০০৮ সালের এপ্রিল মাস থেকে ২০০৯ সালের আগস্ট পর্যন্ত ১৬ মাসে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজারে মোট ৮০ জনের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ২২ জন মারা যান। বাকিদের মধ্যে রয়েছেন বান্দরবানে ২০ জন, রাঙামাটিতে ১৩ জন, কক্সবাজারে ৯ জন ও খাগড়াছড়িতে ১৬ জন। এসবের মধ্যে বান্দরবানের লামা’র আজিজনগরে পাহাড় ধসের একটি ঘটনায়ই ১৪ জনের মৃত্যু ঘটে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো সবগুলো ঘটনায়ই নিহতদের বেশিরভাগ ছিল নারী ও শিশু।

মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে পাহাড় ধসের ঘটনা ঠেকাতে পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা যায়, গত দু’ বছরে পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র ২১টি মামলা রুজু করার রেকর্ড রয়েছে। একই সময়সীমার মধ্যে পাহাড় কর্তনকারী ৪০ জনকে দেয়া হয়েছে সতকর্তা নোটিশ। কিন্তু এসব ‘ঠুনকো’ প্রশাসনিক ব্যবস্থা পাহাড় ধ্বংসকারীদের কর্মকান্ড রোধ করতে কোনও ভূমিকাই রাখছে না বলে স্থানীয় বাসিন্দারা জানান।

পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ড. শাহজাহান খন্দকার বলেন, অবাধে পাহাড় কাটা, বৃ নিধন, জুম চাষের জন্য পাহাড় পোড়ানো এবং পাথর আহরণের জন্য বিস্ফোরক দিয়ে পাহাড় ধংস অব্যাহত থাকায় তিন পার্বত্য জেলার একের পর এক পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। বিরাজমান পরিস্থিতিতে পাহাড়ে মোটামুটি ভারি বৃষ্টি হলেই বিস্তীর্ণ এলাকায় ধস নামে। পাহাড় ঘেঁষে গড়ে উঠা ঘর-বাড়িগুলো অত্যন্ত ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে, যে কোনও সময়েই ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে এসব এলাকার বাসিন্দাদের জীবনে।

বাংলাদেশের স্থানীয় সময়: দুপুর ১২: ১৫ মিনিট, ১৬ জুন, ২০১০
ঝজজ/অক/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।