ঢাকা, রবিবার, ২৯ ভাদ্র ১৪৩২, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২১ রবিউল আউয়াল ১৪৪৭

জাতীয়

পাকিস্তানি খানদের সহযোগী ‘বাঙালি খান’

অশোকেশ রায়, আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮:৩৪, মার্চ ৮, ২০১৬
পাকিস্তানি খানদের সহযোগী ‘বাঙালি খান’ মীর কাসেম আলী /ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (ফাইল ফটো)

ঢাকা: চট্টগ্রাম অঞ্চলজুড়ে নানা মাত্রায় নানা ধরনের নৃশংসতম মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছেন। চট্টগ্রামে গড়েছেন মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র বিরোধিতাকারী জামায়াতের কিলিং স্কোয়ার্ড আলবদর বাহিনী, পরে হয়েছেন এ বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষনেতা।

নিজে জড়িত থেকে এবং আলবদরদের নেতৃত্ব দিয়ে হত্যা, গণহত্যা সংঘটন করে ঘাতকের কুখ্যাতি পেয়েছেন। বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল তালিকা প্রণয়নকারীদেরও তিনি একজন।

তিনি হচ্ছেন মীর কাসেম আলী। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও বাঙালিদের নির্যাতনের বীভৎস পৈশাচিকতায় মেতে উঠেছিলেন তিনি। এ নৃশংসতার মাত্রা এতোটাই ভয়াবহ ছিল যে তাকে সে সময় থেকেই ডাকা হয় ‘বাঙালি খান’ নামে। ইয়াহিয়া খান ও টিক্কা খানদের যোগ্য এই দোসর এ নামেই কুখ্যাত।  

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। হত্যা ও নির্যাতনে পারদর্শিতার পুরস্কার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে তাকে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। তখন মীর কাসেম আলী এ বাহিনীর তিন নম্বর ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। এ সময় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী। দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

একাত্তরের সেই ঘাতক, চট্টগ্রাম তথা সারা দেশে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধানতম সহযোগী এবং শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেম আলীকে এর আগে ২০১৪ সালের ০২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়েছিলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। আর মঙ্গলবার (০৮ মার্চ) একাত্তরে হত্যা-গণহত্যার দায়ে তার ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের রায়ের বিরুদ্ধে করা তার আপিল আবেদন আংশিক খারিজ করে দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতের এই কর্মপরিষদ সদস্যের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলার সংক্ষিপ্ত আকারে চূড়ান্ত এ রায় দেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের আপিল বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন- বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।

অন্যদিকে মীর কাসেমের বিরুদ্ধে আনা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০টিই প্রমাণিত হয়েছে এবং ৪টি প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেননি বলে উল্লেখ করে বিচারিক আদালতের রায় দিয়েছিলেন চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মুজিবুর রহমান মিয়া ও শাহীনূর ইসলামের সমন্বয়ে ৩ সদস্যের ট্রাইব্যুনাল।

আটজনকে নির্যাতনের পর হত্যা ও মরদেহ গুম এবং ২৪ জনকে অপহরণের পর চট্টগ্রামের বিভিন্ন নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্যাতনসহ মানবতাবিরোধী ১৪টি অভিযোগে অভিযুক্ত হন মীর কাসেম আলী। চূড়ান্ত রায়ে অভিযোগগুলোর মধ্যে ৭টি অর্থাৎ ২, ৩, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৪ নম্বর অভিযোগে ফাঁসিসহ ৫৮ বছরের কারাদণ্ডাদেশ এবং ৭টি অর্থাৎ ১, ৪, ৫, ৬, ৮, ১২ ও ১৩ নম্বর অভিযোগ থেকে অব্যাহতি ও খালাস পেয়েছেন তিনি।

এর মধ্যে ১১ নম্বর অভিযোগে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিম উদ্দিনসহ মোট ৬ জনকে হত্যার দায়ে কাসেমের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত। অন্যদিকে প্রমাণিত ২ নম্বর অভিযোগে ২০ বছর, ১৪ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর এবং ৩, ৭, ৯ ও ১০ নম্বর অভিযোগে ৭ বছর করে কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধের এই মূল হোতাকে।

আপিল বিভাগ তার রায়ে কাসেমকে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩’এর ৩(২) (এ) (জি) (এইচ), ৪(১) ও ৪(২) এবং ২০ ধারায় ধারায় বর্ণিত অপরাধের দায়ে ফাঁসির দণ্ডাদেশ ও ভিন্ন ভিন্ন মেয়াদে শাস্তি দিয়েছেন। ৪(১) ও ৪(২) ধারায় সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি (ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) ও জয়েন্ট ক্রিমিনাল এন্টারপ্রাইজ (যৌথ দায়বদ্ধতা) হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে আলবদর বাহিনী ও ছাত্রসংঘের অপরাধের তাই বর্তেছে তার ওপরে।

মধ্যযুগীয় বর্বরতার নজির
ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ১০৪৬ প্যারাগ্রাফ সম্বলিত মোট ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের প্রত্যেকটি অংশে ছড়িয়ে আছে মীর কাসেম আলীর নৃশংসতার বিভিন্ন বিবরণ। তার বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দেওয়া ২৪ সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন তার হাতে নির্যাতিত এবং আরও ৫ জন ছিলেন শহীদ বা নির্যাতিতের পরিবারের সদস্য। তারা সরাসরি বর্ণনা দিয়েছেন তাদের বা তাদের স্বজনদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহতম মধ্যযুগীয় সে নির্যাতনের। প্রধানত চট্টগ্রামের মহামায়া ভবন দখল করে গড়া ডালিম হোটেল নির্যাতন কেন্দ্রে এসব নির্যাতন ও নির্যাতন শেষে হত্যার ঘটনা ঘটে। তাই রায়েও বারে বারে এসেছে ডালিম হোটেলে সংঘটিত নৃশংসতার বর্ণনা।

‘একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ’ বইয়ের লেখক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় মীর কাসেম আলী তৎকালীন ডালিম হোটেলে (বর্তমানে মহামায়া ভবন) শত শত বাঙালিকে ধরে এনে হত্যা ও নির্যাতন করেন। স্বাধীনতার পর ডালিম হোটেল থেকে অনেক বাঙালিকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। ’

ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার সাংবাদিক সাক্ষী নাছিরুদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডালিম হোটেলকে নরকে পরিণত করেন মীর কাসেম আলী। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের লোকজনকে ধরে এনে পা ছাদের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চলানো হতো, প্রস্রাব করে তা পানে বাধ্য করা হতো, বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। নির্যাতনের কারণে অনেক বাঙালির মৃত্যু হয়েছে। ’

মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মীর কাসেম আলী নগরীর নন্দন কানন টিঅ্যান্ডটি অফিসের পেছনে হিন্দু মালিকানাধীন ‘মহামায়া ভবন’ দখল করে নেন। ভবনটি আলবদর বাহিনী নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর এর নামকরণ করা হয় ‘ডালিম হোটেল’।

কথিত এ ডালিম হোটেলে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন বাঙালিকে ধরে এনে  রড ও বৈদ্যুতিক শক দিয়ে নির্যাতন করা হত। হোটেলে নির্যাতনের শিকার লোকজন যখন পানি চাইতেন তখন রাজাকাররা প্রস্রাব করে তা পান করতে দিতো। যখন তারা প্রস্রাব পান করতে চাইতেন না, তখন নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে প্রস্রাব পান করতে বাধ্য করতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক দিন পরও ডালিম হোটেলের আশ-পাশের এলাকায় অসংখ্য মরদেহ পড়েছিল।

ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মুক্তিযোদ্ধা ও বাঙালিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন ন্যাপ নেতা সাইফুদ্দিন খান, তৎকালীন জেলা ন্যাপের সভাপতি এ এন নুরুন্নবী, ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনের দুই কর্মকর্তা অরুণ কুমার চৌধুরী ও শফিউল আলম চৌধুরী, ড. ইরশাদ কামাল খান, ড. মোসলেহ উদ্দিন খান, জেলা ন্যাপের নেতা অ্যাডভোকেট শফিউল আলম (বেবী শফি), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, চীনপন্থি ন্যাপ নেতা মো. সেলিম এবং মেজবাহ খান প্রমুখ।  

শুধু ডালিম হোটেলই নয়, আছদগঞ্জের দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবির বিল্ডিংস্থ চামড়ার গুদাম, পাচলাইশ থানার সালমা মঞ্জিল, মদিনা হোটেল ও প্রবর্তক মোড়ে আরও চারটি নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে তোলেন মীর কাসেম। স্বাধীনতাকামীদের নির্যাতনের জন্য গড়া এ পাঁচটি নির্যাতনকেন্দ্রের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয় ডালিম হোটেলে।   

বাঙালি খান
মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে এবং নিয়ন্ত্রণে ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্র পরিণত হয় জল্লাদখানায়। আলবদর বাহিনীর সদস্যরা চট্টগ্রাম আলবদর বাহিনীর প্রধান ও কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে ভিকটিমদের সামনে কখনও ‘কমান্ডার’ আবার কখনও ‘কমান্ডার খান’  আবার কখনো ‘বাঙালি খান’ নামে ডাকতো। ডালিম হোটেলের নির্যাতন কেন্দ্রে কাসেমের নেতৃত্বেই অমানবিক নির্যাতনে হত্যা করা হয় কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সন্দ্বীপের জসিম, রঞ্জিত দাস লাতু, টুন্টু সেন এবং আরও পাঁচজনকে।

এ মামলায় মীর কাসেমের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন পঞ্চম সাক্ষী শহীদ রঞ্জিত দাসের ছেলে শিবু দাস, সপ্তম সাক্ষী শহীদ হন টুন্টু সেনের ভাগ্নে প্রদীপ তালুকদার এবং ১৭তম সাক্ষী শহীদ জসিমের বড় ফুপাতো বোন হাসিনা খাতুন। তারা তাদের সাক্ষ্যে বলেন, অমানবিক নির্যাতনে হত্যার পর মুক্তিযোদ্ধা জসীম, টুন্টু সেন ও রঞ্জিত দাসসহ ৮ শহীদের মরদেহ গুম করে ফেলেন কাসেমের বাহিনী।   পরে তারা জানতে পেরেছেন, হত্যা করে তাদের মরদেহ কর্ণফুলী নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তাই তাদের মরদেহ গত ৪৩ বছরেও খুঁজে পাননি স্বজনেরা।

মীর কাসেম আলী মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে চট্টগ্রামে বাঙালি কিলিং স্কোয়াডের প্রধান হিসেবেও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ জন্য সহযোগী যুদ্ধাপরাধীরা তাকে ‘টর্চার আইডল’ নামেও ডাকতেন।

আজও শিউড়ে ওঠেন চট্টগ্রামবাসী
মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে চট্টগ্রামে আলবদর বাহিনীর সদস্যরা পাকিস্তানি দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় স্থানীয় বুদ্ধিজীবী, পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর আগ্রাসন প্রতিরোধে প্রতিরোধ বাহিনীর সদস্য মুক্তিযোদ্ধাদের ও মুক্তিকামী নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ধরে এনে নির্যাতনকেন্দ্রে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালাতো, হত্যা করতো এবং মরদেহ গুম করে ফেলতো। মীর কাসেম আলী ও তার আলবদর বাহিনী তাই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে চট্টগ্রামে মুক্তিকামী মানুষের জন্য আবির্ভূত হয়েছিল ভয়ঙ্কর রূপ নিয়ে। কাসেম ছিলেন চট্টগ্রামের বিভীষিকা। তার জল্লাদখানার নাম দোস্ত মোহাম্মদ পাঞ্জাবি বিল্ডিংয়ের চামড়ার গুদাম, সালমা মঞ্জিল এবং ডালিম হোটেলসহ ৫টি নির্যাতন কেন্দ্র।

জুন মাসের মধ্যেই আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী এসব নির্যাতনকেন্দ্র গড়ে চট্টগ্রামসহ দেশের সর্বত্র ব্যাপকহারে গণহত্যা, হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, উচ্ছেদ, বিতাড়ণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিতকরণ ইত্যাদি মানবতাবিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধগুলোর অপরাধী চক্রের মূল ধারায় সম্পৃক্ত হন। নিজেও সরাসরি অপরাধ সংঘটিত করেন তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশ্ব মানবতার শত্রু হিটলারের নাৎসি বাহিনীও একইভাবে একই কাজ করেছিল।

চট্টগ্রামের মানুষ আজও বিভীষিকা, জীবনের আতঙ্ক, জল্লাদখানা এবং নির্যাতন কেন্দ্রগুলোর নামে আঁতকে ওঠে। নতুন প্রজন্ম প্রতিনিয়ত চলার পথে সেগুলোর দিকে তাকায় প্রচণ্ড ঘৃণাভরে। মীর কাসেম আলীর নামে তাই আজও শিউড়ে ওঠেন চট্টগ্রামবাসী।

যেভাবে আলবদরের ৩য় শীর্ষ নেতা
মীর কাসেম আলীর জন্ম ১৯৫২ সালের ৩১ ডিসেম্বর। তার বর্তমান বয়স ৬২ বছর। তার ডাক নাম পিয়ারু। পিতার নাম মৃত মীর তায়েব আলী, মাতার নাম মৃত রাবেয়া বেগম, (সৎ মাতা মৃত ডলি বেগম)। তারা মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার মুন্সীডাঙ্গী সুতালরি গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন। বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী পিতার কর্মস্থলের কারণে চট্টগ্রামে আসেন তিনি। ঢাকায় থাকতেন মিরপুর-২ এর দক্ষিণ মনিপুরের মোল্লাপাড়ায়।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে অধ্যয়নরত থাকাবস্থায় ১৯৬৭ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে অধ্যয়নরত থাকাকালে ইসলামী ছাত্রসংঘের কলেজ শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালে চট্টগ্রাম শহর শাখা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি নিযুক্ত হন।

১৯৭১ সালে ৬ নভেম্বর ১৯৭১-১৯৭২ সেশনের নিখিল পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কার্যকরী পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ৭ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন।

ইসলামী ছাত্রসংঘ পরে রূপান্তরিত হয় কিলিং স্কোয়াড আলবদর বাহিনীতে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মীর কাসেম আলী জামায়াতসহ অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর সহযোগিতায় ইসলামী ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের সমন্বয়ে সশস্ত্র আলবদর বাহিনী গঠন করেন। সেই আলবদর বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম আলী স্বাধীনতাবিরোধী মূল ধারার সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন।
 
ওই সময়কালে ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য ও ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান আব্দুল জাহের মোঃ আবু নাসের, তৎকালে চট্টগ্রাম জেলা ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবু তাহের, তৎকালীন চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী বর্তমানে মানারত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক এনামুল হক মঞ্জু, তৎকালীন জামায়াতের চট্টগ্রাম জেলা শাখার সভাপতি মাওলানা মোঃ সামসুদ্দিন, তৎকালীন জামায়াতের শহর শাখার সাধারণ সম্পাদক ও পরবর্তীতে ইসলামী ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের সাবেক সদস্য বদিউল আলম, তৎকালীন চট্টগ্রাম সোবহানিয়া আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ও বর্তমানে শিল্পপতি, তৎকালীন চট্টগ্রাম কমার্স কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আফসার উদ্দিন চৌধুরী, শাহজাহান (বর্তমানে মৃত), শাহ আলম(বর্তমানে মৃত), শাহ জালাল, ডা. শামীম, ডা. হাং (বর্তমানে মৃত), জাহাঙ্গীর চৌধুরী, রবিউল হোসেন, কাফি (বর্তমানে মৃত) ও মীর মোঃ শোয়েবদের সমন্ময়ে তাদের অনুসারী ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মী-সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর সহায়ক বাহিনী হিসেবে আলবদর বাহিনী গঠন করেন মীর কাসেম। আলবদর বাহিনীর প্রথমে চট্টগ্রাম শহর শাখার কমান্ডার ও পরবর্তীতে অন্যতম কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ব্যাপকভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ, গণহত্যা, হত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুন্ঠন ইত্যাদি সীমাহীন বর্বরতম অপরাধ সংঘটিত করেন তিনি।   

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস্ বাহিনীর প্রধান ও কেন্দ্রীয় কমান্ডার হিসেবে যারা দায়িত্ব পালন করেছিলেন ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় নেতা হিসেবে মীর কাসেম আলী ছিলেন তাদেরই একজন। তিনি পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের হাইকমান্ডের তৃতীয় স্থানে অধিষ্ঠিত হন। ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান দখলদার সেনাবাহিনী ও তাদের সহযোগী বাহিনীর আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত তিনি এ দায়িত্বে ছিলেন।
 
উর্ধ্বতন নেতৃত্ব ও বুদ্ধিজীবী হত্যা
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে অভিযোগে ছিল সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটিতে থাকা নেতা হিসেবে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করা, হত্যা, অপহরণ, আটক, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদির ঘটনা। মীর কাসেম আলী নিজে এবং এ দেশীয় তার অন্যান্য আরো সহযোগীদের নিয়ে চট্টগ্রামে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পগুলোতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে এসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। সেলিম মনসুর খালেদ অনুদিত আলবদর (উর্দু গ্রন্থ) বইয়ের ১৩৩ নম্বর পৃষ্ঠা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ১৯৭১ সালের ১০ মে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আযম ও অপারেশন চিফ ফাতেমী চট্টগ্রামের ছাত্রসংঘের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে পরামর্শ করেন, নিউল (নেভাল) হেডকোয়ার্টার্সে সেনাযাত্রী ছাউনিতে সভা করেন এবং জুনের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রাম শহরে আলবদরের একটি কোম্পানি গঠন করেন। এর কমান্ডার মীর কাসেম এসব সভায় উপস্থিত থেকে সমগ্র জেলায় আলবদরের ৩৭টি প্লাটুন গঠন করে দেন।


বুদ্ধিজীবীদের হত্যার উদ্দেশ্যে স্বাধীনতার উষালগ্নে যে তালিকা তৈরি করা হয়, সেটি তৈরিতেও ভূমিকা রাখেন তিনি।

সাংগঠনিক/প্রাতিষ্ঠানিক বিভিন্ন স্তর বিন্যাসে বিরাজমান বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যে অপরাধের দায় নিরূপণ বিষয়ে এটি একটি প্রতিষ্ঠিত নীতি যে, অধীনস্তদের দ্বারা অপরাধের দায় উর্ধতন অবস্থানে যিনি বিরাজ করেন, তার ওপর গিয়ে সরাসরি বর্তায়। এ প্রতিষ্ঠিত ধারণা এবং মূলনীতি আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ধারা ৪(২)-এ উল্লেখ করা হয়েছে। গণহত্যা, গণহত্যা সংঘটনে ষড়যন্ত্র, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও হত্যা, ব্যাপক নির্যাতনযজ্ঞ, দেশত্যাগে বাধ্য করা, নির্যাতন, ধর্ষণ, ধর্মগত ও রাজনৈতিক কারণে ক্রমাগত নির্যাতনের সুপিরিয়র হিসেবে সব অপরাধের একক ও যৌথ দায় মীর কাসেমের ওপর বর্তায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে রায়ে।

এ প্রসঙ্গে অভিযোগ করা হয়েছে, ‘আসামি কাসেম আলী উপরোক্ত অপরাধসমূহ সংগঠনের নিমিত্তে ষড়যন্ত্র, উস্কানি ও সম্পৃক্ততা তথা পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, আদেশ প্রদান ও অপরাধ সংগঠনের বাস্তবায়নের সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন ১৯৭৩-এর ৩(২), ৪(১) ও ৪(২)-এর অধীনে অপরাধসমূহ সংগঠনে ভূমিকা রাখেন’।

অভিযোগে বলা হয়, ‘আসামি মীর কাসেম আলী কেবল তার নিজের কৃত অপরাধের জন্যই দায় বহন করেন না। বরঞ্চ তার উর্ধতন অবস্থানের কারণে আসামি তার অধীনস্থ এবং প্রভাবাধীন সাংগঠনিক পরিকাঠামোর অধীন বিভিন্ন সংগঠন, ব্যক্তিবর্গের কৃত অপরাধের দায়ও আসামির ওপর বর্তায়। এ পরিকাঠামোর অধীন সংগঠনসমূহ হলো: জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র সংঘ, ও আলবদর বাহিনী। অতএব আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ধারা ৪(১) এর আলোকে আসামি অপরাধমূলক দায়ের স্বরূপ একই সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং যৌথ’।

‘আসামি তার নিয়ন্ত্রণাধীন আলবদর বাহিনীর মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ষড়যন্ত্র, উস্কানি ও সম্পৃক্ততা তথা পরিকল্পনা, পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, আদেশ প্রদান ও অপরাধ সংগঠনের বাস্তবায়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকার কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সকল অধস্তন নেতাকর্মীদের কৃত সকল অপরাধ সংঘটনের দায়েও দায়ী’।

‘একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আসামি মীর কাসেম আলীর নেতৃত্বে এবং প্রভাবাধীন যে সাংগঠনিক পরিকাঠামো, তার পুরোটা নিয়েই ছিল সহযোগী বাহিনী (auxiliary forces)। এই সংগঠনসমূহ বা বাহিনীগুলো তৈরিই করা হয়েছিল সরাসরি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন অপারেশন এবং পরিকল্পনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নের সহায়তা করা। আসামি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এবং তার নিয়ন্ত্রণাধীন সাংগঠনিক পরিকাঠামো নিয়ে পাকিস্তানিদের সঙ্গে অপরাধে সম্পৃক্ত ছিলেন’।

‘আসামি মীর কাসেম আলী ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক এবং আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে উর্ধতন অবস্থানে (Superior status) থাকা অবস্থায় ব্যক্তিগতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনালস) আইন, ১৯৭৩-এর ধারা ৩(২) অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য একাধিক অপরাধ সংঘটন করেছেন’।

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ডিসেম্বর গভীর রাত পর্যন্ত এই আলবদর বাহিনীই অপহরণ করা হয় এদেশের সূর্যসন্তান বুদ্ধিজীবীদের। বিজয়ের পরে ১৭-১৮ ডিসেম্বর তাদের কয়েকজনের ক্ষত-বিক্ষত, গলিত-অর্ধগলিত মৃতদেহ উদ্ধার করা হলেও বাকিরা আজও নিখোঁজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দশ জন শিক্ষক, ছয় জন সাংবাদিক ও দুই জন চিকিৎসকসহ ১৮ জন শহীদ বুদ্ধিজীবী অপহরণ, নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন মুক্তিযুদ্ধের শেষ সপ্তাহে।

আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা হিসেবে বুদ্ধিজীবীদের নির্মম নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডে তার নেতৃত্বদানের অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে।

বক্তৃতা-বিবৃতিতে উস্কানি
মীর কাসেম আলীর বিরুদ্ধে সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটির (উর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায়) অংশ হিসেবে অপরাধ সংঘটনে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ষড়যন্ত্র, উস্কানি, আদেশ প্রদান ও সরাসরি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের আহবান জানানোর অভিযোগও প্রমাণিত হয়েছে। তিনি সভা-সমাবেশে বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে তার এ উস্কানি কৌশলের অংশ হিসেবে প্রধানত দেশের স্বাধীনতাকামী জনগণ, হিন্দু সম্প্রদায়, প্রগতিশীল সেক্যুলার গোষ্ঠী, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ‘দেশের শত্রু’, ‘ইসলামের শত্রু’, ‘ভারতের চর’, ‘দুষ্কৃতকারী’ ইত্যাদি অভিহিত করে তাদের বিরুদ্ধে জনমনে, বিশেষত আসামির সাংগঠনিক এবং আদর্শিক অনুসারীদের মনে, ঘৃণা এবং বিদ্বেষ ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন বলে রায়ে উল্লেখ রয়েছে।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকায় এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে লিপিবদ্ধ আছে, চট্টগ্রামের মুসলিম ইন্সটিটিউটের সুধী সমাবেশে ‘পাকিস্তানের বর্তমান জাতীয় সংকট ও নাগরিকদের দায়িত্ব’ শীর্ষক আলোচনায় পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের কেন্দ্রীয় সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তান রক্ষায় সময়োচিত হস্তক্ষেপ ও সাফল্যের জন্য সেনাবাহিনীর প্রশংসা করেন। এ সুধী সমাবেশের অনুষ্ঠানে পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম শহর শাখার সভাপতি মীর কাসেম আলী সভাপতিত্ব করেন।

১৯৭১ সালের ২ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত আরেক সংবাদে বলা হয়, ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু নাসের, শহর শাখার সভাপতি মীর কাশেম আলী ও জেলা শাখার সভাপতি আবু তাহের আসন্ন প্রতিরক্ষা দিবস পালনের জন্য দেশপ্রেমিক জনগণের প্রতি আহবান জানান। বিবৃতিতে তারা আরও জানান যে, ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রতিরক্ষা দিবস পালনের জন্য যথাযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর দৈনিক আজাদী পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ৮ নভেম্বর অপরাহ্ন ২ ঘটিকায় চট্টগ্রামের স্থানীয় মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বদর দিবস উপলক্ষে আলবদর বাহিনী আয়োজিত এক সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। চট্টগ্রাম সেক্টরের উপ সামরিক আইন প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার আতা মোহাম্মদ খান মালিক এস কে সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যোগদান করতে সম্মত হয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের চট্টগ্রাম জেলা সভাপতি মাওলানা মোহাম্মদ তাহের, শহর সভাপতি মোহাম্মদ আবু তাহের এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবু নাসের বদর দিবস উপলক্ষে গৃহীত চট্টগ্রাম বদর বাহিনীর কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।

১৯৭১ সালের ৮ নভেম্বর দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, বদর দিবস পালন উপলক্ষে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে ইসলামী ছাত্রসংঘের উদ্যোগে এক গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। গণজমায়েতের অন্যান্যদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন যে, আজকের বদর দিবসের শপথ হল- ক. ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়াবো, খ. দুস্কৃতকারীদের খতম করবো, গ. ইসলামী সমাজ কায়েম করবো।

১৯৭১ সালের ২৪ নভেম্বর দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকায় এক সংবাদ প্রকাশিত হয়। এতে বলা হয়, ‘পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি ভুমি রক্ষার খাতিরে সৈনিক হিসেবে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য দেশের দেশপ্রেমিক যুবকদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন। ... ভারতের ওপর মরণাঘাত হানার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি প্রস্তুতি নেওয়ার জন্যে ছাত্রসংঘ নেতাদ্বয় দলীয় কর্মীদের প্রতি নির্দেশ দেন’।

১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদ ‘হিন্দুস্তানী হামলার বিরুদ্ধে গণসমাবেশ’ শীর্ষক এক সংবাদ প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ‘শুক্রবার বিকেলে বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গনে আয়োজিত এক গণসমাবেশে যেকোনো মূল্যে পাকিস্তানের উপর হিন্দুস্তানের হামলাকে প্রতিহত করার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহবান জানানো হয়। আলবদর বাহিনী এই গণসমাবেশের আয়োজন করে। উক্ত গণসমাবেশে পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাসেম আলী হিন্দুস্তানের যুদ্ধবাজ ও আকাশবাণীর মিথ্যা প্রচার ও গুজবে বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য জনসাধারনের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন যে, আমরা সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছি। খোদার রহমতে জয় আমাদের অবধারিত’।

স্বাধীনতার পরেও থামেনি অপকর্ম
মীর কাসেম আলীর স্বাধীনতাবিরোধী তৎপরতা ও নৃশংসতা একাত্তরেই শেষ হয়ে যায়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি নিধন পর্ব শেষে স্বাধীনতার পর ঢাকায় পালিয়ে গিয়ে নিজেকে মিন্টু নামে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা চালান তিনি। কিন্তু আসল মুখোশ উন্মোচন হয়ে গেলে আরেক যুদ্ধাপরাধী মাঈনুদ্দিনের সঙ্গে পালিয়ে যান লন্ডনে। সেখান থেকে সৌদি আরবে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর মীর কাসেম আলী আবার দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘকে ইসলামী ছাত্রশিবিরে পরিণত করেন তিনি। মীর কাসেম আলী শিবিরের সভাপতি পদে নিযুক্ত হয়ে এদেশে রগকাটা ও সন্ত্রাসের রাজনীতি শুরু করেন।

১৯৮০ সালে জামায়াতের কর্মী হিসেবে যোগদান করে সদস্যপদ গ্রহণ করেন এবং নির্বাহী পরিষদের সদস্য নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের সুরা ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য হিসেবে নিয়োজিত আছেন।

মীর কাসেম আলী ১৯৮০ সাল থেকে সৌদি আরবভিত্তিক বেসরকারি সংস্থা রাবেতা আলম আল ইসলামীর বাংলাদেশে কান্ট্রি ডিরেক্টর। দেশে মুসলমান হত্যা ও ইসলাম বিপন্ন- এ ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে সৌদিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পন্তা ও নানা কৌশলে অনুদান আনতে থাকেন। এরপর থেকে তার অর্থনৈতিক উত্থান ঘটতে থাকে। ব্যক্তিগতভাবেই অবৈধভাবে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক ও ধনকুবের বনে যান তিনি।

জামায়াত-শিবিরের অর্থ যোগানদাতা মীর কাসেম আলী দলটির অলিখিত কোষাধ্যক্ষ বা খাজাঞ্চি হিসেবে পরিচিত। ব্যাংক, চিকিৎসা সেবা, পরিবহন, টেলিযোগাযোগ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা সেক্টরে তার নেতৃত্বে জামায়াতিরা গড়ে তুলেছে মজবুত ভিত। গণমাধ্যম জগতেও তার বিচরণ ঘটেছে। তিনি ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ভাইস চেয়ারম্যান ও পরিচালক, ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালসের বোর্ড অব ডিরেক্টর সদস্য। দিগন্ত পেপার মিলের একক মালিক মীর কাসেম আলী ফুয়াদ আল খতিব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, এগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাস্ট ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। দিগন্ত মিডিয়া কর্পোরেশনের চেয়ারম্যানও তিনি। এ গ্রুপ পরিচালনা করে দৈনিক নয়াদিগন্ত ও বন্ধ হয়ে যাওয়া দিগন্ত টেলিভিশন।

একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে শুরু থেকেই দেশে-বিদেশে অঢেল অর্থ ব্যয় করে আসছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস নামক একটি লবিস্ট ফার্মকে এ উদ্দেশ্যে তিনি প্রায় ১৮২ কোটি টাকা দেন। ওই প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি করেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাসেম আলী। পরে তার প্রবাসী ভাই মীর মাসুম আলী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে নকিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন দু’টি প্রতিষ্ঠান আরো দুটি লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়।

এছাড়া মীর কাসেম আলী রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সহায়তার জন্য রামু থানার খুনিয়া পালং এলাকায় রাবেয়া আল ইসলামীর আর্থিক সহায়তায় প্রতিষ্ঠা করেন রাবেতা হাসপাতাল। যেটি জামায়াত-শিবিরের অস্ত্রের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। দেশে নাশকতা সৃষ্টিসহ নানা কাজেও অঢেল টাকা ঢেলেছেন তিনি। বিশ্বব্যাংক যাতে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থ না দেয় সেক্ষেত্রে মীর কাসেম আলীর লবিং রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৫ ঘণ্টা, মার্চ ০৮, ২০১৬
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।