ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

চাষাড়া বোমা হামলার ১০ বছরে রাজনীতি ছাড়া কিছুই হয়নি

তানভীর হোসেন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৯ ঘণ্টা, জুন ১৬, ২০১১
চাষাড়া বোমা হামলার ১০ বছরে রাজনীতি ছাড়া কিছুই হয়নি

নারায়ণগঞ্জ: ২০০১ সালের ১৬ জুন থেকে ২০১১ এর ১৬ জুন সময়ের মাঝে কেটে গেছে ১০টি বছর। কিন্তু আজো উম্মোচিত হয়নি নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আওয়ামীলীগ অফিসে বোমা হামলার রহস্য।



সেদিনের ভয়াবহ সে ঘটনায় নির্মম মৃত্যু ঘটে ২০ জনের। নৃশংস ওই বোমা হামলায় নিহততের স্বজনদের কান্না আজো থামেনি। শরীরের বিভিন্ন স্থানে স্প্রিন্টারের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন বেঁচে থাকা আহত ব্যক্তিরা আজও।

নিহতদের স্বজনদের অভিযোগ, ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামীলীগ ও বিএনপি উভয় দলই এ মামলা নিয়ে কুটিল রাজনীতিতে মেতে ওঠে। ফলশ্রুতিতে আজও উম্মোচিত হয়নি নারকীয় এ হত্যাযজ্ঞের প্রকৃত রহস্য।

তবে তাদের প্রত্যাশা, বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে মামলাটির সুষ্ঠু সমাধান হবে, উচিত শাস্তি পাবে প্রকৃত দোষীরা।

ভয়াবহ সে স্মৃতি
২০০১ সালের ১৬ জুন বিকেলে সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্রছাত্রী সংসদের তৎকালীন জিএস আকতার হোসেন ও তার সহোদর সংগীত শিল্পী মোশারফ হোসেন মশু বিকেলে বাড়ি থেকে বের আওয়ামী লীগের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে দারুণ একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেতে শামীম ওসমানের সঙ্গে পরমর্শ করতে। মশু তার এক বোনকে বলেছিলৈন রাতে বিস্তারিত আলোচনা করবেন সাংস্কৃতক অনুষ্ঠান নিয়ে।

আকতার ছেলে অশিনকে বলেছিলেন টিভিতে ক্রিকেট খেলা দেখতে- রাতে এসে তার কাছ থেকে খেলার বিস্তারিত শুনবেন।

পরে দু’ ভাই বাড়ি ফিরেছিলেন, তবে যথাসময়ে আর জ্যান্ত অবস্থায় ফেরেননি। আওয়ামীলীগ অফিসে সেদিনকার বোমা হামলা তাদেরকে চিরদিনের মত কেড়ে নিয়েছে স্বজনদের কাছ থেকে। শহরের ৩৪ নম্বর উত্তর চাষাঢ়ার আক্তার-মশুর বাড়িটিতে এখনো যেন কান্না থামেনি।

আকতা হোসেনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় রাতেই। সবাই ভেবেছিল মশু হয়তো কোথাও আছে। তখনো তারা জানেন না- ভয়াবহ ওই ঘটনায় দু’ভাইয়েরই মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। মশুর মৃত্যুর খবর তারা পান পরদিন টিভি দেখে।

আকতারের স্ত্রী শাহনাজ আক্তার বাংলানিউজকে বলেন, ‘বোমা হামলার ঘটনার পরে নারায়ণগঞ্জে এসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বোমা হামলার ঘটনার সুষ্ঠু বিচারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর সরকার পরিবর্তন ঘটে। এখন তিনি আবারো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। আমরা তাঁর সেই প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন চাই। ’

বোমা হামলায় আরও যারা মারা যান তাদের মধ্যে আছেন- ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী। তার স্ত্রী আনোয়ারা বেগম জানান, চার বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন ভাসানী। দুই ছেলের পিতা ভাসানী ফতুল্লার বিসিক শিল্প নগরীর ক্রনি অ্যাপারেলসে সুতা সরবরাহ করতেন।

আনোয়ারা জানান, তাদের পরিবার বর্তমানে চরম অর্থকষ্টে চলছে। দুই ছেলেই স্কুলে পড়াশোনা করছে। তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর ১০টি বছর কেটে গেলেও কোনও বিচার হলো না। এটাই বড় আফসোসের। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবার এর বিচার করবেন এটা আমাদের আশা। ’

বোমা হামলায় নিহত স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা ঘটনার দিন স্থানীয় একটি ব্যাংকে চাকরির তদবির করতে গিয়েছিলেন শামীম ওসমানের নিকট। চাকরি হলে সংসারের বোঝাটা হাল্কা হয়ে যেত বেশ। কিন্তু সংসারের বোঝা হাল্কা করতে গিয়ে তার নির্মম অসহায় মৃত্যু স্বজনদের ওপর অনেক ভারী হয়ে পড়েছে এখন। নিহত সবুজের পরিবার এখন চলছে দিন আনি দিন খাই অবস্থায়।

বিকেলে অসুস্থ স্বামীর পা ব্যান্ডেজ করে বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ফতুল্লা থানা মহিলা আওয়ামীলীগের আহবায়ক পলি বেগম। কিন্তু আওয়ামীলীগ অফিসে বোমা হামলার শিকার পলি নিজেই চলে গেলেন সব ধরনের সেবা শুশ্রুসার অতীতে।

শিশুকন্যার জন্য কোন ব্র্যান্ডের দুধ আনতে হবে তা স্ত্রী আনোয়ারার কাছ থেকে জেনে নিয়ে বিকালে বন্ধুর সঙ্গে বাসা থেকে বেরিয়ে যান হানিফ নূরী। তিনি কোনও রাজনৈতিক দলের কর্মী ছিলেন না। শিশু কন্যার খাবার আনতে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় আওয়ামীলীগ অফিসে গিয়ে বর্বরোচিত বোমা হামলার শিকার হন। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারীকে হারিয়ে অসহায় পরিবারটি আজ দু’চোখে অন্ধকার দেখছে।

নারায়ণগঞ্জ শহরের নিতাইগঞ্জের দাসপাড়ার ছেলে ছিল স্বপন চন্দ দাস। ডিগ্রি পাসের পর চাকরির চেষ্টায় ছিল। স্বপনের বাবা যোগেশ চন্দ দাস (৭০) জানান, সেদিন এমপি শামীম ওসমান ছাত্রলীগ নেতা সাঈদুল হাসান বাপ্পীকে তার সঙ্গে দেখা করতে যেতে বলেন। স্বপনও বাপ্পীর সঙ্গে গিয়েছিল এমপির কাছে নিজের চাকরির সুপারিশ করতে।

যোগেশ বলেন, ‘ছেলে আমার কাছ থেকে ১০ টাকা নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল, এমপির সুপারিশ আনতে পারলেই চাকরি হয়ে যাবে। রাতে তার মৃত্যুর খবর শুনি। ’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতদের পরিবারের কয়েকজন স্বজন জানান, ঘটনার পর নিহতদের পরিবারের পক্ষ থেকে কোনও প্রকার মামলা করা হয়নি। তাদেরকে মামলা করতেও দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় আওয়ামীলীগের পক্ষ থেকে বিএনপির ২৭জনকে আসামি করে মামলা করা হয়। পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতার আসার পর আওয়ামীলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে। এভাবে বোমা হামলার ঘটনা নিয়ে একে অন্যের সঙ্গে দড়ি টানাটানি খেলায় মেতে ওঠে দু’দল।

মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি
বোমা হামলায় আহত চাষাঢ়া ইউনিয়ন আওয়ামীলীগ সহসভাপতি সৈয়দ লুৎফর রহমান সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘রাত তখন ৮টা ৪৫ মিনিট। বিকট শব্দ। তারপর আমি আর কিছুই বলতে পারবো না। পরে জানতে পারি বোমা বিস্ফোরণের প্রায় ২০ মিনিট পর আমার আত্মীয় রফিক আমাকে কোলে তুলে গাড়িতে করে ২০০ শয্যা হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখনও আমি সজ্ঞাহীন। সেদিন ২০টির বেশি স্পিøন্টারের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। একেকটি স্পিøন্টার যেন রাইফেলের একেকটি গুলির মতো। দু’দিন পর জ্ঞান ফিরে আসে। যখন জেগে উঠি তখন দেখি আমার ডান পার উপরের অংশ থেকে অনবরত রক্ত বের হচ্ছে। এরপর দীর্ঘ তিন মাস হাসপাতালে থাকতে হয়। ’

তিনি আরও বলেন, ‘শরীরে অসংখ্য স্পিøন্টার নিয়ে এখনো বেঁচে আছি শুধু স্বাধীনতাবিরোধীদের বিচার দেখে যেতে চাই বলে। ’

বোমা হামলার শিকার হয়ে মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছেন ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির জেলা সভাপতি চন্দন শীল। কিন্তু পা দু’টোকে সারা জীবনের জন্য হারাতে হয়েছে। হাঁটুর ওপর থেকে কেটে ফেলতে হয়েছে। কৃত্রিম পা নিয়ে কোনোমতে চলাফেরা করেন।

চন্দন শীল বলেন, ‘মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করেছি, তাই একে আর ভয় পাই না। যারা চাষাঢ়াসহ সারা দেশে এ বর্বরোচিত বোমা হামলা চালিয়েছে, আমৃত্যু তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যাব। ’

বর্তমান সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, বোমা হামলার মামলাগুলোর তদন্ত শুরু হয়েছে এটা একটা ভালো দিক। ’ তবে অনুযোগের সুরে বলেন, ‘তদন্ত চলছে ঢিমেতালে। ’ চন্দন শীল মামলাটির দ্রুত নিস্পত্তি এবং দোষীদের কঠোর শাস্তি চান।

সে রাতে যা ঘটেছিল
২০০১ সালের ১৬ জুন শনিবার বিকাল থেকেই চাষাড়া শহীদ মিনার গা ঘেষা আওয়ামীলীগ অফিসে তৎকালীন এমপি শামীম ওসমানের গণসংযোগ কর্মসূচিতে দলের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে জড়িত নেতৃবৃন্দরা জড়ো হতে থাকেন। রাত ৭টার মধ্যে পুরো অফিস লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা কেউ জানতেন না তাদের প্রাণের স্পন্দন কেড়ে নিতে অথবা কারো অঙ্গহানি করার জন্য সেখানে পুঁতে রাখা হয়েছে শক্তিশালী বোমা।

হলঘরের একেবারে দক্ষিণ দিকে ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জ আসনের সাংসদ শামীম ওসমান বসে এলাকার মানুষের কথা শুনছেন। একেকজন একেক সমস্যা নিয়ে আসছেন। কারো চাকরির সুপারিশ, কারো চিকিৎসা সংক্রান্ত তদবির, কারো ভর্তির সমস্যা।

হলঘর পার হয়ে একটি কক্ষ। সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের খাস কক্ষ। হলঘরের পরের ঘরটিতে তখন আলোচনায় বসেছিলেন দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ ইউনিয়ন এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। কয়েক দিন পরেই নারায়ণগঞ্জের দেওভোগে জনসভা করবেন শামীম ওসমান। সভার আলোচনা প্রায় শেষ পর্যায়ে। সভা শেষ করার কথা শামীম ওসমানের। কিন্তু মানুষের কথা শুনতে শুনতে উঠে আসতে পারছিলেন না তিনি। তাই ফোন করে আনালেন তার পিএস, কৃষক লীগ নেতা চন্দন শীলকে।

চন্দন শীলকে দায়িত্ব দেওয়ার পর তিনি ভেতরে ঢুকছিলেন সভায় যোগ দিতে। শামীম ওসমান ওঠার পরপরই রাত পৌনে ৯টায় এতক্ষন তার বসে থাকার স্থানের অদূরেই বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে শক্তিশালী বোমার।

নিহতদের পরিচয়
বোমা বিস্ফোরণে মুহূর্তেই শরীর দেহ ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যায় সেখানে উপস্থিত অসংখ্য ব্যক্তির। এদের মধ্যে একজন নারীর পরিচয় এখনও জানা যায়নি। নিহত অন্যরা হলেন, শহর ছাত্রলীগের সভাপতি সাইদুল হাসান বাপ্পী, সহোদর সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের জিএস আকতার হোসেন ও সঙ্গীত শিল্পী মোশাররফ হোসেন মশু, সঙ্গীত শিল্পী নজরুল ইসলাম বাচ্চু, ফতুল্লা থানা আওয়ামীলীগ যুগ্ম সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন ভাসানী, নারায়ণগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক এবিএম নজরুল ইসলাম, স্বেচ্ছাসেবকলীগ নেতা সাইদুর রহমান সবুজ মোল্লা, মহিলা আওয়ামীলীগ নেত্রী পলি বেগম, ছাত্রলীগ কর্মী স্বপন দাস, কবি শওকত হোসেন মোক্তার, পান-সিগারেট বিক্রেতা হালিমা বেগম, সিদ্ধিরগঞ্জ ওয়ার্ড মেম্বার রাজিয়া বেগম, যুবলীগ কর্মী নিধু রাম বিশ্বাস, আব্দুস সাত্তার, আবু হানিফ, এনায়েতউল্লাহ স্বপন, আব্দুল আলীম, শুক্কুর আলী ও স্বপন রায়।

জানা গেছে, নিহত অজ্ঞঅত পরিচয় মহিলার পরিচয় পেতে তেমন কোনও চেষ্টা করেনি প্রশাসন। হামলায় শামীম ওসমানসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন। এছাড়া শামীম ওসমানের ব্যক্তিগত সচিব চন্দন শীল, যুবলীগ কর্মী রতন দাস দুই পা হারিয়ে চিরতরে বরণ করেছেন পঙ্গুত্ব।

মামলা দায়ের
২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলার ঘটনার পর নারায়ণগঞ্জ শহর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা বাদী হয়ে পৃথক দু’টি মামলা করেন। মামলায় স্থানীয় বিএনপির ২৭ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়। পরবর্তীতে বিএনপির শাসনামলে ২০০৩ সালের এপ্রিল মাসে মামলা দু’টির ফাইনাল রিপোর্টে বলা হয়, ‘উল্লেখিত ২৭ জনের কেউই চাষাড়া আওয়ামীলীগ অফিসে ১৬ জুন ২০০১ সালের বোমা হামলায় জড়িত নয়। যদি ভবিষ্যতে অত্র মামলার তথ্য সম্বলিত ক্লু পাওয়া যায় তবে মামলাটি পুনরজ্জীবিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। ’

বিএনপির শাসনকালসহ দীর্ঘ প্রায় ৬ বছর মামলাটি হিমাগারে থাকার পর মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সিআইডির আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২ জুন নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালত মামলাটি পুনরুজ্জীবিত করে সুষ্ঠুভাবে তদন্ত করে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য সরকারকে আদেশ দেয়।

চাষাড়া বোমা হামলা মামলাটি দীর্ঘ প্রায় নয় বছর পর ২০০৯ সালের মে মাসের ১৬ তারিখে নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের চাঞ্চল্যকর ও লোমহর্ষক মামলা নিস্পত্তি সংক্রান্ত জেলা মনিটরিং কমিটির সভায় চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে  অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

মামলার বর্তমান অবস্থা
আওয়ামীলীগের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত বিএনপি ও এর অঙ্গদলের ২৭ আসামিকে প্রথমবারের মত গত বছরের ৬ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয় আদালত। মামলাটি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আরিফুর রহমানের আদালতে বিচারাধীন। মামলা তদন্তে রয়েছেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (ঢাকা) মোজাম্মেল হক।

শামীম ওসমান যা বলেন
বোমা হামলায় গুরুতর আহত তৎকালীন এমপি শামীম ওসমান বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি, নারায়ণগঞ্জে খালেদা জিয়া, নিজামীসহ যুদ্ধাপরাধীদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা, টানবাজার পতিতা পল্লী উচ্ছেদে তৎকালীন যেসব গোষ্ঠীর স্বার্থ বিঘিœত হয়েছিল তারা তখন মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ওই ষড়যন্ত্র ও অপপ্রচারে শরিক হয়। ’

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ‘ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারের পাশাপাশি ২০০১ সালের ১৬ জুন বোমা হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করে ওই চক্রটি। ২১ আগস্ট ও ১৬ জুনের বোমা হামলা একই চক্রের এবং একই সূত্রে গাঁথা। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার প্রয়োজন। ’

বর্তমান সরকার দ্রুত এ বিচার কাজ করবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মামলায় গ্রেপ্তারকৃতরা
২০০৫ সালের ১ অক্টোবর গ্রেপ্তার হয় হরকাতুল জেহাদের অন্যতম নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। গ্রেপ্তারের পর তিনি র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থার নিকট দেওয়া জবানবন্দিতে চাষাড়া বোমা হামলায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। ২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতের রাজধারী দিল্লির একটি রেল স্টেশন হতে হরকাতুল জিহাদের ২ জঙ্গি সহোদর আনিসুল মোরসালিন ও মুহিবুল মুত্তাকিনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বাড়ি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। তারাও বোমা হামলার ঘটনা স্বীকার করেছেন। দু’জনই বর্তমানে দিল্লি কারাগারে বন্দী রয়েছেন। বোমা হামলা মামলার বারো নাম্বার আসামি শাহাদাৎ উল্লাহ জুয়েল নারায়ণগঞ্জের শীর্ষ সন্ত্রাসী ক্রস ফায়ারে নিহত মমিনউল্লাহ ডেভিড ও পরিবহন সন্ত্রাসী মাহবুব উল্লাহ তপনের ছোট ভাই।

২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর শহরের মিশনপাড়ার বাসভবন থেকে জুয়েলকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-১১। জুয়েলের বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ কার্যালয়ের সামনে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলার অর্থ জোগান দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুকে চাষাড়া বোমা হামলা মামলায় গত বছরের ১০ নভেম্বর শ্যোন অ্যারেস্ট দেখায় সিআইডি। এছাড়া গ্রেপ্তার হয়েছেন ঢাকার ৫৩ নাম্বার ওয়ার্ড কমিশনার ও ঢাকা মহানগর বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক আরিফুর রহমান। তাদের কয়েক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে সিআইডি।

বাদী-বিবাদীর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য
মামলার বাদী খোকন সাহা জানান, বোমা হামলার পর দায়ের করা দু’টি মামলার সুষ্ঠু তদন্ত না করে ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়া হয়েছিল। সে সময়ে বাদী হওয়া সত্ত্বেও এ ভ্যাপারে আমাকে কোনও প্রকার অবহিত করা হয়নি। বাদীকে না জানিয়েই ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করে তদন্তকারী কর্মকর্তা। তখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। যারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ও প্রিয়জন হারিয়েছেন, তাদের সঙ্গেও কোনও আলোচনা করা হয়নি। এর ফলে তখনই মামলাটি হিমাগারে চলে যায়।

মামলা পরিচালনাকারী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আনিসুর রহমান দিপু জানান, আশা করছি অচিরেই এর তদন্ত কাজ শেষ হবে। প্রকৃত আসামি কারা তা বেরিয়ে আসবে। ইতিপূর্বে এ মামলার তদন্তকারী সংস্থার বিরুদ্ধে চরম হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সর্ষের ভেতর ভূত রয়েছে কি না তা ভেবে দেখার বিষয়। ’

আওয়ামীলীগের দায়ের করা মামলার প্রধান আসমি সাবেক ডেপুটি অ্যাটর্নী জেনারেল, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-আইন বিষয়ক সম্পাদক ও জেলা কমিটির সভাপতি তৈমুর আলম খন্দকার জানান, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিএনপি নেতাদের ঘায়েল করার জন্য মামলাটি পুনুরুজ্জীবিত করা হলে তা হবে দুঃজনক। কারণ বোমা হামলার পর তৎকালীন বিচারপতি আ. ওহাবের নেতৃত্বে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটির রিপোর্টেও বলা হয়েছিল- এ ঘটনার সঙ্গে বিএনপির ২৭ আসামি জড়িত নয়। তৃতীয় কোনও পক্ষ এ হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। কিন্তু এর বিরুদ্ধে মামলার বাদী কোনও নারাজী পিটিশন করেনি।

দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি
এদিকে দিবসটি পালনে সকালে শহীদ পরিবারের পক্ষ হতে পৌরসভার উদ্যোগে নির্মিত স্মৃতি স্তম্ভে পুস্পমাল্য অর্পণ ও শহরে শোক র‌্যালি করা হয়। এছাড়া দিনভর কোরআন তেলোয়াত ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছ। বিকালে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে শোক সমাবেশ ও রাতে একই স্থানে মোমবাতি প্রজ্জ্বলন করা হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫২ ঘণ্টা, ১৬ জুন, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ