ঢাকা: ‘বৃষ্টি ঝরে, ঝরে মধুর দানা / আকাশ ঢাকে, কৃষ্ণ মেঘের ডানা / কান্না ঝরে কার / প্রিয়ংবদা শ্যামা মেয়ে বরষার। ’ সূর্য আলো ছড়াবার ঢের আগে রবীন্দ্রসংগীতের সুরে সুরে কাজলকালো মেঘের নিচে টিপটিপ বৃষ্টির অপরূপ মায়াভরা রূপের বন্দনা করে আজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বরণ করে নেওয়া হলো বর্ষাকালের প্রথম দিনটিকে--- বাংলা ১৪১৭ সনের ১লা আষাঢ় ---আষাঢ়স্য প্রথম দিবসকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি ও চারুকলা অনুষদের লিচুতলায় বর্ষার গান গেয়ে, কবিতা পড়ে, নেচে নেচে বাঙালির আবেগ জড়িয়ে, উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পালন করা হয়েছে ‘বর্ষাউৎসব’।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে সাজানো হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলামের বর্ষা নিয়ে লেখা কবিতা-গানের ছত্রে সাজানো ব্যানার ও পোস্টারে। ক্যাম্পাসের রাস্তায় রাস্তায় লাগানো হয়েছে সদ্য ফোটা কদমফুলের রঙিন ছবি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে হাকিম চত্বরে বর্ষাকে স্বাগত জানান বিহ্নশিখা শিল্পীগোষ্ঠী, সুরসপ্তক ও সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা। শিল্পী অদিতি মহসিনের কন্ঠে ‘পদ্ম মানিক দিয়ে গাঁথা মালা আষাঢ়কে পরিয়ে দিয়ে’ এই গান দিয়ে শুরু হয়। এরপর গানে গানে চলে বর্ষাবন্দনা। পরে বর্ষার গানের সাথে ব্যতিক্রমী নাচ পরিবেশন করে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নৃত্যস্পন্দন’র একটি দল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আআমস আরেফিন সিদ্দিক এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান সম্মানিত অতিথি হিসেবে এ উৎসব উদ্বোধন করেন ।
উদ্বোধনী বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, চার দেয়ালের মধ্যে আবদ্ধ আমাদের নতুন প্রজন্ম বাংলা ঋতু সম্পর্কে খুবই কম জানে। এভাবে ঘটা করে বর্ষা উৎসব আয়োজন করে নতুন প্রজন্মকে বর্ষার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে ধন্যবাদ জানান।
এসময় বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান নতুন করে প্রকৃতিকে সবুজের সমারোহে সাজানোর আহ্বান জানান। তিনি বলেন, এখন বর্ষাকাল আছে কিন্তু বৃষ্টি নেই। বন উজাড় করা বন্ধ করে ও পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করে আমাদের সবুজ শ্যামল প্রকৃতিকে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে।
অতিথিদের বক্তব্যের পর সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘খেলাঘর’ এর শিশুদের মধ্যে গাছের চারা বিতরণ করে নতুন প্রজন্মকে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হবার জন্য অনুপ্রাণিত করা হয়।
কলাভবনে বর্ষাবরণের খানিকটা পরেই চারুকলা অনুষদের লিচুতলায় শুরু হয় বর্ষা উৎসব। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর আয়োজনে এ বর্ষা উৎসবে মেয়েরা নীল-সাদা শাড়ি এবং হাতে ও মাথার খোঁপায় কেয়া-কামিনী ফুলের মালা পরে বর্ষার গানে গানে মেতে ওঠে বর্ষা বরণে।
চারুকলার শীতল ছায়ায় মিতা হকের কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘বাদল দিনের প্রথম কদমফুল তুমি করেছ দান, আমি দিতে এসেছি শ্রাবণেরও গান’, সুমা রায়ের কন্ঠে অতুল প্রসাদের ‘বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথা, আজি পড়িছে মনে মম কত কথা’ গানের সাথে সাথে জমে ওঠে বর্ষা বরণ উৎসব।
এরপর রবীন্দ্রনাথের ‘নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে, ওগো আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে’ “বর্ষা” কবিতাটি আবৃত্তি করে শোনান উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ঝর্ণা সরকার।
বর্ষা নিয়ে লেখা রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত, আধুনিক গান, লোকসংগীত, অতুলপ্রসাদ সেন ও রজনীকান্তের গানের মাঝে মাঝে পরিবেশন করা হয় বর্ষার গানের সাথে একক ও দলীয় নাচ।
উদীচীর ব্যতিক্রমী আয়োজন ছিল ‘বর্ষাকথন’। বর্ষাকথনে বর্ষাউৎসবের ঘোষণা পাঠ করেন উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন। এসময় বর্ষা নিয়ে কথা বলেন অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী ও অধ্যাপক কাজী মদিনা।
বর্ষার ঘোষণা পাঠে বলা হয়, বাংলার কৃষি, কৃষক ও বর্ষা এদের মাঝে যে অচ্ছেদ্য বন্ধন তা বাঁচিয়ে রাখতে হলে পরিবেশ দূষণ, বন উজার, নদী ভরাট ও উষ্ণায়ন রোধ করতে হবে। বাংলার কৃষি ও কৃষককে বাঁচাতে বর্ষার প্রথম দিনে এ প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করা হয়।
এসময় উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীরা আশা প্রকাশ করেন, সন্ত্রাস ও অপসংস্কৃতির ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে বর্ষার আবহ জাতির জীবনে বুলিয়ে দেবে শান্তির পরশ।
বাংলাদেশ স্থানীয় সময়: ১৩৩৬ ঘন্টা, জুন ১৫, ২০১০।
এএডি/এমএমকে/জেএম