মৌলভীবাজার: দেশের বৃহত্তম হাওর হাকালুকিতে শতভাগ বোরো ধান কাটা শেষ। ঘরে ঘরে ধান উঠেছে।
এক ফসলি এলাকা হওয়ায় হাওর অঞ্চলের মানুষ বোরো মৌসুমেই পালন করেন নবান্ন উৎসব। তার ওপর গত দুই মৌসুমে হাকালুকি অঞ্চলের ৫ উপজেলায় দীর্ঘস্থায়ী বন্যা আর জলাবদ্ধতার পর এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। সুতরাং সর্বত্র পাকা ধানের ম ম গন্ধের সঙ্গে তাল রেখে কৃষকের মুখে আর মনেও হাসি আর আনন্দের দোলা লাগছে।
টানা দু’টি মৌসুম আগাম বন্যায় হাওর পাড়ের কৃষক বোরো ধান হারিয়ে ছিলেন দিশেহারা। জীবন তবু থেমে থাকে না! সে কারণে দমে থাকেননি এখানকার কৃষকরাও। নতুন উদ্যমে চলতি মৌসুমে আরো বেশি করে বোরো আবাদ করেন।
এবার প্রকৃতি তাদের নিরাশ করেনি! হাওর অঞ্চলে চোখ জুড়ানো সোনালী সবুজ ধানে ছেয়ে গেছে। এই চোখ জুড়ানো ফসলের হাসি দেখে কৃষকের চোখে আর প্রাণে খুশির জোয়ার বইছে। ধানকাটা শেষে ধান মাড়াইয়ের কাজ চলছে ধুমসে। একই সঙ্গে মাড়াই শেষে চলছে গোলায় ভরা। চলছে নবান্ন উৎসবের জন্য প্রস্তুতিও!
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আবদুল জলিল মিয়া বাংলানিউজকে জানান, নিয়মিত বৃষ্টিপাত হওয়ায় এবার বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া, জুড়ী, বড়লেখা, ফেঞ্চুগঞ্জ এবং গোলাপগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়।
তিনি জানালেন, চলতি মৌসুমে এখন পর্যন্ত হাকালুকি হাওরের ২৫ হাজার হেক্টর জমিতে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার ৫শ’ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে, যা নিকট অতীতের হিসাবে রেকর্ড ফলন।
তবে প্রকৃত হিসাবে ফলন আরও বেশি হয়েছে বলে তিনি জানান।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে মৌলভীবাজার জেলায় বোরো আবাদের লক্ষমাত্রা ছিল ৪৭ হাজার ৩শ’ ৫৯ হেক্টর এলাকা। আর আবাদ হয়েছে ৫৫ হাজার ১শ’ ৯৬ হেক্টর জমিতে যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় ৭ হাজার ৮শ’ ৩৭ হেক্টর বেশি।
আরো জানা যায়, গত মৌসুমে বন্যার কারণে হাকালুকি হাওর পাড়ের ৫ উপজেলার মধ্যে কেবল জুড়ী, কুলাউড়া ও বড়লেখাতেই ৩ হাজার ১শ’ ২৪ একর জমির ধান পানিতে তলিয়ে বিনষ্ট হয়। এর বিপরীতে চলতি মৌসুমে এ ৩ উপজেলায় ৪ হাজার ৫শ’ ৩১ একর জমিতে বোরো ধান উৎপাদিত হয়েছে। জেলার ৬টি হাওরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ফলন হয়েছে হাকালুকিতেই।
প্রায় ১৮ হাজার একর আয়তনের হাকালুকি হাওরের মধ্যে এ বছর প্রায় ১১ হাজার ৪শ’ ৩২ একর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়।
হাকালুকি পাড়ের জুড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমএ মুমিত আশুক বাংলানিউজকে জানান, ‘বোরোর আশাব্যঞ্জক ফলন হাকালুকি হাওরাঞ্চলের লাখো মানুষের মধ্যে নিরন্তর আনন্দের উপলক্ষ নিয়ে এসেছে। বছরের বাকি দিনগুলোর জন্য খাবারের যোগান গোলায় ওঠাতে পেরে কৃষকরা এখন অনেকটাই নির্ভার।
সরেজমিন হাকালুকি হাওর তীরের কুলাউড়া উপজেলার ধলিয়া বিল এবং জুড়ী উপজেলার চাতলা বিল ঘুরে কৃষকদের চোখে-মুখে সেই আনন্দের ছটাই দেখা গেল।
পথ চলতে চলতে কৃষক হোসেন মিয়া (৫৩), মুছা মিয়া (৬০), আব্দুল হক (৬০) ও আব্দুল মন্নানের (৫৫) সঙ্গে কথা হলো। হাসি মুখে তারা জানান, বোরো ধানই হাওর অঞ্চলের মানুষের একমাত্র ফসল। তাই এটা ছাড়া এ অঞ্চলের কৃষকের আর কোনো জাতের ধান লাগানোর সুযোগ নেই। গত দুই বছরের বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবার অন্য বছরের চেয়ে বেশি জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। তাই, এবার ফলনও হয়েছে বাম্পার!
তবে শ্রমিক সঙ্কটের কারণে এবার চড়া মজুরিতে শ্রমিক দিয়ে ধান কাটাতে হয়েছে বলে জানালেন তারা। তবে তারপরেও তারা সন্তুষ্ট, কারণ ফলন বাম্পার হয়েছে।
কৃষকরা জানান, গত ১৫ এপ্রিল থেকে বিআর ২৮ জাতের ধান কাটা শুরু করে ইতোমধ্যে শতভাগ ধান কাটা শেষ হয়েছে। এখন চলছে মাড়াই আর রোদে শুকিয়ে গোলায় ভরার কাজ। তারপর নবান্ন উৎসব!
অনেকেই শুরু করে দিয়েছেন উৎসব। হাওরাঞ্চলের রীতি অনুযায়ী যার ধান আগে গোলায় উঠছে তার বাড়িতেই শুরু হয়ে যাচ্ছে আনন্দ-উৎসব। এভাবে গোটা বৈশাখ আর জৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে চলবে হাকালুকি অঞ্চলে নবান্নের উৎসব।
বাংলাদেশ সময়: ১২২০ ঘণ্টা, মে ০৯, ২০১১