ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

সংবিধান সংশোধন নিয়ে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়াবেন না

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১১
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়াবেন না

ঢাকা: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে না জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞরা। বিদায়ী প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাধায়ক সরকারের প্রধান উপেদষ্টা হিসেবে নিয়োগের বিধান বাতিলেরও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।



তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে বিচার বিভাগকে জড়ালে বিচারিক কাজ বাধাগ্রস্ত হবে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে না রেখে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে রাখার পক্ষেও অবস্থান নিয়েছেন তারা।

এছাড়া সংবিধানে রাষ্ট্রধর্মের উল্লেখ না রাখার বিষয়ে অভিন্ন মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোববার সংবিধান সংশোধনে গঠিত বিশেষ কমিটির ১৮তম বৈঠকে তারা এ মত দেন। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা জানান ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম।

তিনি বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রধান বিচারপতিকে রাখা হলে বিচার বিভাগে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে বলে আজকের বৈঠকে প্রায় সবাই মত দিয়েছেন। তবে এর বিকল্প হিসেবে কে প্রধান উপদেষ্টা হতে পারেন সে ব্যাপারে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আসেনি। ’

বিচারকদের অভিশংসন বিষয়ে ব্যারিস্টার আমীর বলেন, ‘বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছেই থাকা উচিত। প্রয়োজনে কাউন্সিলকে আরো সংস্কার করা যেতে পারে। ’

বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে থাকলে সঠিকভাবে এ কাজটি সম্পন্ন হবেনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ব্যরিস্টার আমীর আরো বলেন, ‘ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করি রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকতে পারেনা। রাষ্ট্র সকল ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করবে। ’

বৈঠক শেষে এ বিষয়ে ব্যারিস্টার রফিকুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের কাছে রাখলে এখানে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কা থেকে যায়। ’

সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রাখার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন প্রবীন এই আইনজ্ঞ।

এর আগে বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তফা কামাল বলেন, ‘বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে এনে কোনো লাভ হবে না। ’

বৈঠকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে আরো শক্তিশালী করার পরামর্শ দেন তিনি।

তিনি বলেন, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে নিজস্ব তদন্ত সংস্থা দিলে এ কাজ আরো সুচারুরূপে করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে বিচারপতির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তদন্ত সংস্থা যাতে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-ট্রমাণ হাজির করতে পারে সে ব্যাপারে তাদের কাজ করতে দিতে হবে।

একই সাথে বিচারপতি নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নেরও পরামর্শ দেন এই সাবেক প্রধান বিচারপতি।

রাষ্ট্রধর্ম বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মতামত দেননি তিনি। শাসনতন্ত্র একটি ওয়ার্কিং ডকুমেন্ট। এর মধ্যে কোনো ইজম না আনাই ভালো বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তত্ত্বাবাধায়ক সরকারের নতুন প্রস্তাব

এদিকে সরকার এবং বিরোধী দল থেকে সমসংখ্যাক সদস্য নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন সিনিয়র আইনজীবি ড. এম জহির।

বিশেষ কমিটিতে নিজের মতামত জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির অধীনে সরকারি দল বা জোট এবং বিরোধী দল বা জোটের পাঁচ জন করে সদস্য নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ থাকবে ওই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। এতে প্রধান উপদেষ্টার কোনো পদ থাকবে না, তবে রাষ্ট্রপতি হবেন প্রধান নির্বাহী।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওই সময়ে নির্বাচন কমিশনকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন তিনি। তার প্রস্তাবিত পদ্ধতির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে এক মাস থেকে ছয় সপ্তাহ।

বিচারপতিদের সংসদে জবাবদিহিতা ও অভিশংসনের বিষয়ে এম জহির জানান, এক্ষেত্রে সুপ্রিম জুডিশিয়ালই কার্যকর ও সক্রিয় করলে ভালো হয়।


সংবিধান কমিশন গঠনের প্রস্তাব কামাল হোসেনের

এদিকে সংবিধান সংশোধনে আবারো একটি সংবিধান কমিশন গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন।

এ ব্যাপারে তিনি বলেন, সংবিধানের মূল কাঠামো পরিবর্তন করতে হলে দেশের ১৬ কোটি মানুষকে আমলে নিয়ে সংবিধান সংশোধন করা বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে একটি কমিশন গঠন করা যেতে পারে যেখানে জনগণের মতামত নেওয়ার একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে।

বিশেষ কমিটির কাছে দেওয়া এক লিখিত বক্তব্যে তিনি একথা বলেছেন।

তিনি বলেন, সংবিধানেই সংবিধান সংশোধনের পথ ও পদ্ধতি বলে দেওয়া আছে। উচ্চ আদালত যেভাবে রায় দিয়েছে তার বাইরে গিয়েও কমিটির খুব বেশি কাজ করা উচিত নয়।

ড. কামাল হোসেন বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাহাত্তরে মূল চেতনা নিয়ে সংবিধান সংশোধন করতে হবে। আদালতের রায়ে ও আন্দোলনের মাধ্যমে তা অনেকটা আমরা ফিরে পেয়েছি। এখন যতটুকু দরকার ততটুকু সংবিধান সংশোধনে হাত দেওয়া উচিত। ’

এ নিয়ে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না করার আহ্বান জানান তিনি।

বৈঠকে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইতিহাস তুলে ধরে বলেন, ‘অবাধ নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করতে এর কোনো বিকল্প নেই। ’

রাষ্ট্র ধর্ম বিষয়ে তিনি বলেন, “এ নিয়ে কোনো বিতর্ক তৈরি হোক সেটা চাই না। ”

বিচারপতিদের অভিশংসনের বিষয়ে তিনি বলেন, সংসদের কাছে এ ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার পক্ষে নন তিনি। বরং যেভাবে আছে, কোনো বিচারপতির নৈতিক স্খলন হলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমেই তার বিচার করা যেতে পারে।

সাবেক প্রধান বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করা বিষয়ে ড. কামাল বলেন, অন্য পেশার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি না পাওয়া গেলে কি করার আছে। এটা মেনে নিতেই হবে।

এদিন বৈঠকে অংশ নিয়ে মতামত রাখেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম। দুপুরে যোগ দেন তাফাজ্জাল ইসলাম।

অন্যদিকে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন হোসেন এবং মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান বৈঠকে যোগ দেননি।

সংলাপে অংশ নেওয়া অন্যান্য আইনজ্ঞদের মধ্যে বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, ড. এম জহির, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলাম, অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, আজমালুল হোসেন কিউসি, তৌফিক নেওয়াজ ও ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস।

আমন্ত্রিত আইনজ্ঞদের মধ্যে দেখা যায়নি বিএনপি’র সিনিয়র সহ-সভাপতি টিএইচ খান ও ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদকে।

বিশেষ কমিটির চেয়ারম্যান সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর সভাপতিত্বে বৈঠকে অন্যান্যের মধ্যে কমিটির কো-চেয়ারম্যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, ফজলে রাব্বি মিয়া, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু, আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, শিরিন শারমীন চৌধুরী, ড. হাছান মাহমুদ, আব্দুল মতিন খসরু।

বিশেষ আমন্ত্রণে আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী শফিক আহমেদ ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান প্রফেসর এম শাহ আলম বৈঠকে অংশ নেন।
 
এদিকে গত ১১, ১২ ও ১৩ এপ্রিল গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে এই বিশেষ কমিটি। ওই তিনটি বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বিশেষ কমিটির ১৬টি বৈঠকের আলোচনা ও সিদ্ধান্ত শুনেছেন।

গত ১৮ এপ্রিল নিজেদের ১৭তম বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নেওয়া সিদ্ধান্তগুলোর আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দেয় বিশেষ কমিটি।

ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রোববার সাবেক প্রধান বিচারপতি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছে কমিটি। সোমবার বিরোধী দলীয় নেতা বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদসহ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল রাজনৈতিক দল এবং ২৬ এপ্রিল সংসদ নেতাসহ আওয়ামী লীগের মতামত নেবে কমিটি।

তবে বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া সংলাপে যোগ দেবেন কিনা তা আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও জানানো হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৪, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।