ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

আট বছরেও অনিষ্পন্ন মডেল তিন্নি হত্যা মামলা

হাসান জামিল শিশির/মুবিনুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৫২ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১০

ঢাকা: দীর্ঘ আট বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি অভিনয়-শিল্পী ও মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ওরফে তিন্নি (২৪) হত্যা মামলা। ।

প্রথমে কেরানীগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও পরে মামলা স্থানান্তর হয় সিআইডিতে।

ছয় বছরে অন্তত সাত জন তদন্ত কর্মকর্তাকে বদল করা হয়েছে। অভিযোগপত্র দিতে দীর্ঘসূত্রতা, আদালতে সরকারপক্ষের বার বার সময়ক্ষেপণ, সাক্ষীদের যথাসময়ে হাজিরা না দেওয়াসহ বিভিন্ন কারণে মামলা নিষ্পত্তিতে গড়িয়ে গেছে দীর্ঘ সময়।

গত ১৪ জুলাই ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ (সপ্তম) আদালতে ‘তিন্নি হত্যা ও লাশ গুম সংক্রান্ত মামলা’য় জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ১৬ আগস্ট দিন ধার্য করেছেন আদালত।

এর আগে অভির পক্ষে আইনজীবী গত ১৬ মে ফৌজদারি কার্যবিধি ২৬৫/সি ধারা মোতাবেক এক দরখাস্ত দাখিল করে অভিকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত তা নামঞ্জুর করেন।

তিন্নি হত্যা মামলায় জাতীয় পার্টির সাংসদ গোলাম ফারুক অভিকে অভিযুক্ত করে ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। পুলিশ বাদি হয়ে তিন্নি হত্যা মামলা দায়ের করে। অন্যদিকে মামলার আসামি গোলাম ফারুক অভি পলাতক থাকায় তার পক্ষেও রাষ্ট্রকেই আদালতে উকিল নিযুক্ত করতে হয়েছে।

বাদি ও বিবাদি উভয় পক্ষেই রাষ্ট্র দায়িত্ব নেওয়ায় আরো বেশি সময়ক্ষেপণ হয়েছে বলে আইনজীবীরা মন্তব্য করেছেন।

৭ তদন্ত কর্মকর্তা বদল

সৈয়দা তানিয়া মাহবুব ওরফে তিন্নিকে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর নির্মমভাবে খুন করা হয়। বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে তার মৃতদেহ ফেলে রাখা হয়। নিহতের চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম এ ব্যাপারে কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন। তিন্নির স্বামী এবং তার বাসার কাজের মেয়ে বিনাকে ওই সময় গ্রেপ্তারও করে পুলিশ।

কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই মো: শফিউল বাদি হয়ে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে লাশ গুম করার অভিযোগে অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে ২০০২ সালের ১১ নভেম্বর কেরানীগঞ্জ থানায় মামলা দায়ের করেন। এই মামলার প্রথম তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয় ওই থানার এসআই মোঃ কাইয়ুমকে।

চাঞ্চল্যকর মামলা হিসেবে একই বছর ২৪ নভেম্বর তদন্তভার ন্যাস্ত হয় সিআইডিতে। এরপর একের পর এক তদন্ত কর্মকর্তা বদল হতে থাকেন। সিআইডি পরিদর্শক ফজলুর রহমান, পরিদর্শক সুজাউল হক, এএসপি গোলাম মোস্তফা, এএসপি আরমান আলী, এএসপি কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ এবং এএসপি মোজাম্মেল হক মামলার তদন্ত কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন।  

২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক অভিকে প্রধান আসামি করে সিআইডি অভিযোগপত্র দাখিল করে। তদন্তে দোষ প্রমাণিত না হওয়ায় তিন্নি’র স্বামী শাফাকাত হোসেন পিয়ালসহ পাঁচ জনকে এই মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। অভিযোগপত্রে ৪১ জনকে সাক্ষী করা হয়, জব্দ করা হয় ২২টি আলামত।

মেধাবী ছাত্র থেকে সন্ত্রাসী: অভির খল উত্থান

লেখাপড়ায় অসম্ভব মেধাবী ছিলেন গোলাম ফারুক অভি। এসএসসি এবং এইচএসসিতে বোর্ড পর্যায়ে মেধার স্বাক্ষর রাখায় জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিশেষ নৌভ্রমণের সৌভাগ্য হয়েছিল তার। ‘হিযবুল বাহার’ নামের নেীবাহিনীর এক জাহাজে ওই নৌভ্রমণে যাদের নেওয়া হয়েছিল পরবর্তীতে তারা সবাই ছাত্রদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

গোলাম ফারুক অভি নামের একসময়ের সেই মেধাবী ছাত্র অনেকটা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দিনে দিনে জ্ঞানান্বেষণের পথ থেকে সরে এসে ধাবিত হন পতনের পথে।

মূলত এরশাদের শাসনামলেই অভির উত্থান ঘটে। নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী নিয়ে পুরো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন। পেশীশক্তির মাধ্যমে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে করে তোলেন তার সন্ত্রাসের তল্লাট। বিএনপিনেত্রী খালেদা জিয়াকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করতেন অভি।  

১৯৯০ সালে তার নেতৃত্বাধীন ক্যাডার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তার মিলনকে হত্যা করে। অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসী হিসেবে পুরো দেশে তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়লেও তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ ছিলেন তার পৃষ্ঠপোষক আর পালনকর্তা। এরশাদের ছত্রছায়ায় ছিলেন বলে আইনের লম্বা হাতও নাগাল পায়নি অভির।   শাস্তি দেওয়া দূরে থাক, তার নামটি সন্ত্রাসী তালিকাভুক্ত পর্যন্ত করা হয়নি।

দেশে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, হত্যা, দখলসহ সবধরনের সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে অভি ও তার বাহিনীর স্বতঃফূর্ত অংশগ্রহণ ছিল। নব্বই সালে বাম আন্দোলন দমনের নামে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলগুলোর বহু নেতাকর্মী অভিবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছেন।

একসময়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের হাত ধরে বরিশাল এক আসন থেকে নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য। এভাবেই সন্ত্রাসী অভি বনে যান সাংসদ অভি------অসুর থেকে দেবদূত!

তিন্নি হত্যা মামলার তদন্ত রিপোর্টে জানা যায়, তিন্নির সঙ্গে অভির অবৈধ সম্পর্ক ছিল। স্বামী পিয়ালকে ডিভোর্স করে তাকে বিয়ে করার ভয় আর প্রলোভন দেখিয়ে তিন্নির সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

এক পর্যায়ে বিয়ে না করলে অভির গোপন তথ্য মিডিয়ায় ফাঁস করার হুমকি দেন তিন্নি। এনিয়ে দু’জনের মধ্যে কথাকাটাকাটি হয়। এরই এক পর্যায়ে অভি তিন্নির মাথায় আঘাত করলে মারা যায় তিনি। পরে তার লাশ বুড়িগঙ্গা সেতুর নীচে ফেলে অভি ভারতে পালিয়ে যান।

বিভিন্ন সূত্র জানা যায়, ২০০৪ সালে অভি কানাডায় রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন। সেসময় কানাডা সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে বলা হয়, অভি হত্যা মামলার আসামি, তার দেশত্যাগের পেছনে কোনো রাজনৈতিক কারণ নেই।            

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জুলাই ২৫, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।