চট্টগ্রাম: ‘রাজাকার-আলবদররা গুডস হিলে আনার পর আমাকে বেঁধে উপরে পা, নীচে মাথা দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এরপর আমাকে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা।
এটুকু বলে থামেন চট্টগ্রামের প্রবীণ ব্যবসায়ী নেতা ম. সলিমুল্লাহ। কণ্ঠস্বর কিছুটা রুদ্ধ হয়ে আসে তার।
এরপরের বর্ণনায় যাওয়ার আগে শুধু বলেন, ‘আমি ৪০ বছর ধরে এ দিনটার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। ৪০ বছর ধরে আমি নির্যাতনের চিহ্ন, ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছি। আমি এবার বিচার চাই। ’
একাত্তর সালে তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর বাসভবন চট্টগ্রাম নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার গুডস হিলে নির্যাতনের এমন মর্মস্পর্শী বর্ণনা দেন সলিমুল্লাহ।
মঙ্গলবার বিকেলে গুডস হিলে দাঁড়িয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের সদস্য ও সাংবাদিকদের সামনে তিনি নির্যাতনের কাহিনী বর্ণনা করেন।
এ সময় নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত হিসেবে চারজনের নাম প্রকাশ করেন সলিমুল্লাহ। তারা হলেন- সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর ছোট ভাই সাইফুদ্দিন কাদের চৌধুরী, বিএনপির সাবেক হুইপ ও বর্তমানে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ওয়াহিদুল আলম, তৎকালীন আলশামস বাহিনীর প্রধান খোকা ও মাহবুবুল আলম।
সলিমুল্লাহ বলেন, ‘অসহায় বাঙালিদের নির্যাতন করাটা ছিল তাদের কাছে এক ধরনের উৎসবের মত। এরা বাঙালিদের ধরে নিয়ে সবাই মিলে নির্যাতনের উৎসব করত। ’
গুডস হিলে আটক করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সলিমুল্লাহ বলেন, ‘একাত্তর সালে নগরীর অভয় মিত্র ঘাটে আমি পারিবারিক একটি প্রিণ্টিং প্রেস চালাতাম। সেখানে কর্মচারীরা সবাই ছিল বোয়ালখালী থেকে আসা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। একাত্তরের ২ এপ্রিল সকালে আমার দু’জন কর্মচারীকে ধরে গুডস হিলে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের ছাড়ানোর জন্য আমি সন্ধ্যার দিকে গুডস হিলে যাই। সেখানে গিয়ে আমি গেটে খোকা, মাহাবুব, ওয়াহিদ এবং সাইফুদ্দিন কাদেরকে দেখতে পাই। ’
সলিমুল্লাহ’র ভাষায়, ‘তখন সাইফুদ্দিন কাদের মোটাসোটা, ফর্সা ধরনের ছিল। ওয়াহিদও যুবক ছিল। ’
তিনি বলেন, ‘চারজনের মধ্যে একজন আমাকে দেখিয়ে পাকিনী সেনাদের উর্দুতে বলল এ শালা মালাউনদের আশ্রয় দিয়েছে। তাকেও বেঁধে রাখতে হবে। অবস্থা বুঝতে পেরে আমি গুডস হিলের সামনে থেকে চলে আসি। এরপর আমি মামলা করার জন্য কোতয়ালী থানায় যাওয়ার পথে একটি গাড়িতে কয়েকজন রাজাকার, আলবদর এসে আমাকে গাড়িতে টেনে তুলে ফেলে। এসময় তার পূর্বপরিচিত হিন্দু সম্প্রদায়ের এক ভদ্রলোকও গাড়িতে উঠে যান।
তিনি বলেন, ‘আমাকে গুডস হিলে নিয়ে গিয়ে প্রথমে একটি বাসার ভেতর ঢোকানো হয়। এরপর সেখানে আমাকে উপর-নীচ করে বেঁধে রাইফেলের বাট দিয়ে পেটানো হয়। কতক্ষণ পিটিয়েছিল আমি জানি না। জ্ঞান ফিরলে দেখি আমাকে একটি অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে কক্ষের ভেতর ফেলে রাখা হয়েছে। ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে আমি পানি পানি বলে চিৎকার করছিলাম। এরপর আবার অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সুবেহ সাদিকের সময় আমি কুকুরের ডাক আর গুলির আওয়াজে জেগে উঠি। এসময় এক সেনা সদস্য বাথরুম থেকে ফেরার পথে আমার মুখের উপর তার পাত্র থেকে অবশিষ্ট কিছু পানি ঢেলে দেন। ’
তিনি বলেন, ‘আমাকে মোটর গ্যারেজের যে দোতলা কক্ষে আটক রাখা হয়েছিল সেটির অন্য একটি কক্ষ থেকেও ভেসে আসছিল গোঙানির আওয়াজ। ’
তিনি জানান, পরদিন ৩ এপ্রিল সকাল নয়টায় তার কয়েকজন নিকট আত্মীয়ের অনুরোধে তাকে গুডস হিল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
সলিমুল্লাহ বলেন, ‘আমাকে ছেড়ে দেওয়ার পর ভেবেছিলাম যদি ডিনামাইট মেরে বাসাটা উড়িয়ে দিতে পারতাম!’
তিনি বলেন, ‘আমার উপর নির্যাতন খুবই সামান্য ঘটনা। কিন্তু যারা এত নিরীহ বাঙালিকে মেরেছে, নির্যাতন করেছে, বাঙালি মেয়েদের অপমান করেছে আমি তাদের বিচার চাই, তাদের কঠিন শাস্তি চাই। ’
সলিমুল্লাহ জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর ট্রাইব্যুনাল সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকলে তিনি অবশ্যই যাবেন।
এসময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘একাত্তর সালে যখন আমাকে আটক করা হয়েছিল তখন আমার মেয়ের বয়স ছিল মাত্র আড়াই মাস। আমি সেদিন আল্লাহকে বলেছিলাম-আপনি আমাকে মেয়ে দিয়েছেন, আমার মৃত্যু হলে আমার মেয়েকে আপনি দেখবেন। সুতরাং আমি একাত্তর সাল থেকেই মৃত। আমার আর মৃত্যুভয় নেই। ’
সাকা চৌধুরী ও তার পিতার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমাকে নির্যাতনের সময় আমি তাদের দু’জনকে দেখিনি। তবে তাদের বাসায় এসব ঘটনা ঘটছে আর তারা জানবেন না এমন তো হয় না। ’
এর আগে সোমবার তিনি চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে গিয়ে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত দলের সামনে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দেন।
৬৮ বছর বয়সী প্রবীণ ব্যবসায়ী ম.সলিমুল্লাহ সিএন্ডএফ এজেণ্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি। তিনি চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ব্যবসায়ী সমাজে সৎ ও স্পষ্টভাষী হিসেবে পরিচিত সলিমুল্লাহ’র বাসা গুডস হিলের পাশের এলাকা জামালখানে। তার বাড়ি হাটহাজারীর উত্তর মাদার্শা এলাকায়।
তদন্ত দলকে গুডস হিলের টর্চার সেল দেখিয়ে দেওয়ার পর মুঠোফোনে কাকে যেন বলছিলেন, ‘আজ আমি অনেক বড় একটি কাজ করেছি। ’
এসময় সলিমুল্লাহর চোখেমুখে ছিলো পরিতৃপ্তির ছায়া।
বাংলাদেশ সময়: ২১০২ ঘণ্টা, এপ্রিল ১২, ২০১১