ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

অর্ধাহার-অনাহারে দিন যাচ্ছে দিনাজপুরের ৪০ হাজার চাতাল শ্রমিকের

সানি সরকার, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৫ ঘণ্টা, মে ২, ২০১১
অর্ধাহার-অনাহারে দিন যাচ্ছে দিনাজপুরের ৪০ হাজার চাতাল শ্রমিকের

দিনাজপুর: ‘বাপুরে হামার কষ্টের কথা শুনিয়্যা তোরহা কি কইরবেন, হামরা না মরি কুনো রকম বাঁচি আছি, মুই মালিকেরঠে ট্যাকা নিয়া খায়া ফেলাইছোম, চাতালত ধান পরলেই কাজ করিয়্যা ওমার ধারের ট্যাকা সুজিম, আইজ প্রায় ২ মাস থাকি কাজ না পায়া বসি আছোম, এখন আর কোনো উপায় নাই, ছাওয়া-পাওয়াগুল্যা খায়া-নাখায়া থাকোছে’।

এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন দিনাজপুর সদর উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের ৫৫ বছর বয়সী চাতাল শ্রমিক আব্দুল কাদের।

প্রায় ৪০ বছর যাবত চাতাল শ্রমিক হিসেবে কাজ করে আসছেন তিনি। এখন পুরোপুরি কর্মহীন। প্রতিদিন মিলে এসে খবর নেন চাতালে ধান পড়বে কিনা। কিন্তুধান না-পড়ার খবর শুনে প্রতিদিনই হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয় তাকে। এ অবস্থা চলছে দু’মাসের অধিক সময় ধরে।

আবদুল কাদের চাতাল শ্রমিকের কাজ করেই বহু কষ্টে বড় ছেলেকে এসএসসি পর্যন্তপড়ালেখা করিয়েছেন। কিন্তু পরিবারে অর্থাভাব ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাওয়ায় ছোটছেলে আর মেয়েকে স্কুলে পাঠানোই বন্ধ করে দিয়েছেন তিনি।
 
শুধু আব্দুল কাদের নন, খাদ্যভাণ্ডারখ্যাত দিনাজপুরে এখন সব চাতাল শ্রমিকেরই বড় দুর্দিন চলছে। কাজ না পেয়ে তারা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন। পেটের ক্ষুধা মেটাতে আগাম শ্রম বিক্রি করছেন তার মতো অনেকে।

চাতাল শ্রমিকরা জানেন না, শ্রমের বাজারে ৮ ঘণ্টা শ্রম দেওয়ার নিয়ম। তাদের প্রয়োজন শুধু কাজ এবং পেট পুড়ে খাবার।

এদিকে, বর্তমানে দিনাজপুরে ধান না পাওয়ায় ও পুঁজির অভাবে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন। তাই সিংহভাগ চালকলই এখন বন্ধ। এই কর্মহীন সময়ে বিপুল পরিমাণ এ চাতাল শ্রমিকদের জন্য মিল মালিক বা সরকারের দিক থেকে কোনো সহায়তা কর্মসূচি নেই।

দিনাজপুর চাতাল শ্রমিক সহায়তা কমিটির তথ্যমতে, জেলায় এক হাজার ৮২৯টি হাসকিং মিল রয়েছে। অটোরাইস মিল রয়েছে ৩৮টি। এসব মিলে প্রায় ৪০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন এবং এদের  ৬০ শতাংশই নারী শ্রমিক।

এছাড়া ওই সূত্রমতে, সারা দেশে রয়েছে ১৬ হাজার ৩৫০টি হাসকিং মিল ও ৩৮১টি আটো মিল এবং ২৮৩টি সেমি অটো মিল।
 
সরজমিন গিয়ে দেখা গেছে, ধানের অভাবে হাসকিং মিল এলাকা বলে পরিচিত জেলার পুলহাটে অসংখ্য মিল এখন বন্ধ।

এ ব্যাপারে আসলাম হাসকিং মিলের মালিক আসলাম বাংলানিউজকে জানান, ‘বড় ব্যবসায়ীরা তাদের গোডাউন থেকে ধান বের করে মিল চালাতে পারলেও আমরা পারছি না। ’

ধানের সঙ্কট ও পুঁজি স্বল্পতার কারণে ব্যবসা বন্ধ রেখেছেন তিনি।

তিনি জানান, বৃহৎ মিলকারখানার শ্রমিকদের জন্য আপতকালীন সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকলেও চাতাল শ্রমিকদের জন্য এরকম কোনো ব্যবস্থা নেই।
 
এদিকে, চাতাল শ্রমিক সদর উপজেলার কিসমত মাধবপুরের ছকিনা পারভীন জানান, এখন তারা মাঝে মাঝে বড় দু’একটি মিলে কাজ পেয়ে থাকেন। কিন্তু যে পরিমাণ পারিশ্রমিক পান তাতে সংসার চলে না। তিনি প্রায় ১০ বছর যাবত এ পেশার সঙ্গে যুক্ত।

পাশ্ববর্তী কুরিমুল্লাপুর গ্রামের মহিলা চাতাল শ্রমিক হাছিনা মিলের বেধা (ধান সরানোর জন্য কাঠ ও বাঁশের তৈরি উপকরণ) টানতে টানতে কাছে এসে ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘আপনেরা খালি আসেন আর হামার ছবি তুলি নিয়া পত্রিকায় ছাপে দেন। কিন্তু পরে আর কোনো খোঁজ নেন না। আপনাদের সঙ্গে কথা কইতে দেখলে মালিকেরা হামার ওপর রাগ করে। অনেক সময় কাজ থাকি বাদ দিয়ে দেয়। আপনারা আসলে হামার ভালো তো হয়-ই না, আরও হামার ক্ষতি হয়। ’
 
মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান মোহন পাটোয়ারী জানান, ধান সঙ্কটের কারণে বেশির ভাগ মিলই এখন বন্ধ। ইরি-বোরো ধান উঠলেই মিলগুলো আবার চালু হবে।

মিল বন্ধ থাকার সময় শ্রমিকদের সহায়তা প্রসঙ্গে তিনি জানান, এ বিষয়টি নিয়ে মিল মালিকের পাশাপাশি সরকারেরও ভাবা উচিত।

চাতাল শ্রমিক সহায়তা কমিটির আহবায়ক সাইফুল রাজ চৌধুরী জানান, চাতাল শ্রমিকদের সারা বছরের কাজের কোনো নিশ্চয়তা নেই। নির্দিষ্ট কর্মঘণ্টা, ছুটি ও ওভারটাইম বলেও কিছু নেই। চাতাল শিল্পে কর্মরত নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুরক্ষা নেই। বিশ্রাম ও স্বাভাবিক মানবিক প্রয়োজন পূরণের জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থাও নেই তাদের জন্য।

তিনি জানান, গত ৫ বছরে এ খাতে বিভিন্ন দুর্ঘটনায় (মিলের ফিতা ছিঁড়ে ও বয়লার বিস্ফোরণে) সারাদেশে নিহত হয়েছে অর্ধশতাধিক শ্রমিক। আহত হয়েছে সহস্রাধিক। মিলে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় আহত বা নিহত হলে মিলের পক্ষ শ্রমিক বা তার পরিবারকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার জন্য তিনি সরকার ও মালিকপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

চাতাল শ্রমিক সহায়তা কমিটির সদস্য হামিদুর রহমান জানান, ‘একটি মিলে গড়ে কমপক্ষে ২২ জন শ্রমিক কাজ করে থাকেন। বিশাল এ শ্রমিকদের কল্যাণের কথা এক্ষুণি আমাদের সবাইকে ভাবতে হবে। ’


বাংলাদেশ সময়: ১৮৪৬ ঘণ্টা, মে ০২, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।