ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭ রমজান ১৪৪৫

জাতীয়

১৭ এপ্রিল ১৯৭১

বৈদ্যনাথতলা যেদিন থেকে মুজিবনগর

জুলফিকার আলী কানন, জেলা প্রতিনিধি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১১
বৈদ্যনাথতলা যেদিন থেকে মুজিবনগর

মেহেরপুর: আজ ১৭ এপ্রিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় দিন।

১৯৭১ সালের এ দিনটি ছিল শনিবার।

৪০ বছর আগের সেই শনিবারে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ নিয়েছিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে। সেদিন থেকে ওই জায়গার নাম বদলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে রাখা হয় মুজিবনগর।

সেদিন থেকে বিশ্ব দরবারে মুজিবনগরের পরিচিতি ঘটে নবীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রবাসী অস্থায়ী সরকারের রাজধানী হিসেবে।

একাত্তরের সেই অগ্নিঝরা সময়ে গঠিত হওয়ার পর থেকে দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মুজিবনগর সরকারই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে।

বিমান হামলার আশংকায় ছিল কঠোর গোপনীয়তা

৭১ এর ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের দিন এবং স্থানটির ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়। পাকি হানাদার বাহিনীর বিমান হামলার আশংকায় ছিল এই গোপনীয়তা। তখন কলকাতায় অবস্থানরত কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক ও সাংবাদিক এবং ভারতীয় সাংবাদিকদের খুব সকালে কলকাতা প্রেসক্লাবে হাজির থাকতে বলা হয়।

সে মোতাবেক সকাল ৬টার মধ্যেই কলকাতা প্রেসক্লাবে বিদেশি ও ভারতীয় সাংবাদিক এবং টিভি ক্যামেরাম্যানরা ভিড় জমান। বাংলাদেশের পক্ষে একজন কর্মকর্তা প্রেসক্লাবে হাজির হয়ে সাংবাদিকদের স্বাগত জানান। তবে তিনি সাংবাদিকদের আগাম কোনও কিছু না জানিয়ে শুধু তাদের গাড়িকে অনুসরণ করতে অনুরোধ    করেন।

চলতে শুরু করে সাংবাদিক-কূটনীতিক আর রাজনীতিকসহ বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের  গাড়ির বহর। সাংবাদিকরা তখনও জানেন না, তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক দুর্লভ ঘটনার সংবাদ কাভার করতে যাচ্ছেন।

কলকাতা শহর পার হয়ে গাড়ির বহর ছুটে চলে সীমান্তবর্তী কৃষ্ণনগর শহরের দিকে। তারপর কৃষ্ণনগর পার হয়ে বাংলাদেশের সীমান্তের দিকে এগোতে থাকে। দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গাড়ির বহর আঁকাবাঁকা মেঠোপথ ধরে বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করে। মেঠোপথের চারিদিক ধূলায় ধূসরিত করে একসময় গাড়ির কাফেলা হাজির হয় তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার এক আমবাগানে।

তারা দেখলেন, অনুষ্ঠানস্থলের প্রবেশ পথে বাংলায় লেখা ‘স্বাগতম’।
 
এদিকে সকাল থেকেই বিশাল ছায়াবীথি ওই আমবাগানে স্থানীয় উৎসুক জনতা ভিড় করে আছেন। খালি গায়ে কিশোর ছেলেরা বসে আছে আমগাছের ডালে ডালে। তারা ঠিক জানে না আজ আসলে কী ঘটতে যাচ্ছে এখানে- তবে মুক্তিযোদ্ধাদের সূত্রে টুকটাক তথ্য আর সহজাত অনুভূতিতে সবাই নিশ্চিত যে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটতে চলেছে।

এক আম্রকানন থেকে আরেক আম্রকানন: পরাধীনতা থেকে স্বাধীনতায়

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর এমনি এক আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। ঠিক এর ২১৬ বছর পর সেই পলাশীর অদূরে আরেক আমবাগানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হতে যাচ্ছে। সেই ঐতিহাসিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হতে যাচ্ছেন তারা- এ বিষয়টি অবশ্য সাধারণ প্রত্যক্ষদর্শী আর সাংবাদিকরা আগে আঁচ করতে পারেননি।

আমবাগানের চারিদিকে সশস্ত্র বীর মুক্তিযোদ্ধারা কড়া প্রহরা বসিয়েছেন। সহসাই টিভি ক্রু ও ফটো সাংবাদিকরা ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মন ভরে ক্যামেরাবন্দি করতে শুরু করলেন আশপাশের গুরুত্বপূর্ণ আর সাধারণ সব দৃশ্যকে।

মুক্ত আকাশের নিচে চৌকি পেতে তৈরি করা হয়েছে শপথ মঞ্চ। মঞ্চের ওপর সাজানো ৬ টি চেয়ার। আর বামপাশে কয়েকটি চেয়ার রাখা আছে সাংবাদিকদের জন্য।

স্থানীয় সময় বেলা ১১টা বেজে ৫০ মিনিটে নতুন রাষ্ট্রের নেতারা এলেন জিপে চড়ে। জনতা জয়বাংলা শ্লোগান তুলে ফেটে পড়লো। মঞ্চে উঠে এলেন শীর্ষ আওয়ামীলীগ নেতাদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন (অব.)মনসুর আলী ও জেনারেল    এমএজি    ওসমানী।

আসন গ্রহণপর্ব শেষে অনুষ্ঠানসূচি ঘোষণা করলেন এম এ মান্নান। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। এরপর আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের চিফ হুইপ ইউসুফ আলী ঐতিহাসিক দলিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ শেষে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী পদে তাজউদ্দিন আহমেদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী পদে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদে এইচ এম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী হিসাবে ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর নাম ঘোষণা করলেন।

আর মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ পদে যথাক্রমে এমএজি ওসমানী ও জেনারেল এম এ রবকে নিয়োগের ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপর নয়া সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, মন্ত্রিবর্গ ও সেনাবাহিনী প্রধানকে শপথ বাক্য পাঠ করান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পাকিস্তানি কারাগারে বন্দি থাকায় এ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থিত না থাকলেও বার বার উচ্চারিত হয় তার নাম।

শপথ গ্রহণের পর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবর্গকে একদল মুক্তিযোদ্ধা ও আনসার তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে কুচকাওয়াজসহ গার্ড অব অনার প্রদান করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহম্মেদ তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা যা কিছু করেছি সবই মুজিবের নির্দেশে। ’
এ অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন মেহেরপুরের অধ্যাপক আসাদুল হক, পিন্টু বিশ্বাস, শাহাবদ্দিন সেন্টু প্রমুখ।

এ অনুষ্ঠান থেকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দান ও সামরিক সাহায্যের আবেদন জানান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান গণ পরিষদে নির্বাচিত ১৬৯ জন সদস্যের (সাংসদ) মধ্যে ১৬৭ জন সেদিন উপস্থিত ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর মুজিবনগরকে নতুন প্রজন্ম ও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একটি কমপ্লেক্স গড়ে তোলার কর্মসূচি হাতে নেয়। এই কমপ্লেক্সের কাজ বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে ২৪২ দশমিক ১৫ একর জমি অধিগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। তবে পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে এর কাজ বাধাগ্রস্থ হয়। একপর্যায়ে মাত্র ৩০ একর জমির ওপর মুজিবনগর কমপ্লেক্স স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৭ ঘণ্টা, এপ্রিল ১৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।