ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

বাঘার ঈদমেলায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য

শরীফ সুমন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ৩০, ২০১৪
বাঘার ঈদমেলায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য

রাজশাহী: ঈদ-উল-ফিতরের সময় রাজশাহীর পূর্ব সীমান্ত ঘেঁষা মানুষগুলোর আনন্দ বাঘার ঈদমেলাকে ঘিরে। আর মেলারও প্রাণ ওই মানুষগুলোকে নিয়েই।

যেনো একে অপরের পরিপূরক। প্রতি বছরই বসে এ ঈদমেলা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ঈদের আগের দিন থেকে মেলা শুরু হয়েছে, চলবে ১০ দিন। বাঘার এই ঈদমেলার রয়েছে প্রায় ৫০০ বছরের ঐতিহ্য।

তাই এই মেলা এখানকার মানুষের কাছে অনেক অবেগ এবং গভীর আগ্রহের। পুরনো স্মৃতির পটভূমিতে নতুন করে আঁচর কাটে বাঘার ঈদমেলা। তাই বছর ঘুরে এই দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকে সবাই। যাদের স্বজনরা সীমান্তের ওপারে থাকেন, তারা বছরের নির্দিষ্ট এ সময়টা বেছে নেন একে অপরের সঙ্গে দেখা করার। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাদের বাস ছুটে আসেন তারাও।

পাঁচশ’ বছরের ঐতিহ্যবাহী এ মেলায় বর্তমানে লাখো মানুষের সম্মিলন ঘটেছে। যেন গ্রামের মেঠো পথ ছুঁয়ে ধনী-গরিবের মিলনমেলা বসেছে। কখন রোদ কখনও গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি, তবুও বাঁধ মানছে না। ক্ষণে ক্ষণে সমবেত মানুষের ভিড় বাড়ছেই। মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসব হলেও সব সম্প্রদায়ের মানুষই আসেন এ মেলায়। সার্বজনীন এই মেলায় দেশের দূর-দূরান্ত থেকে জড়ো হন সবাই।

বাঘার ঐতিহাসিক ঈদমেলা এবার ২৩ লাখ ২০ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে। গত ২১ জুলাই বাঘা মাজার শরিফ চত্বরে মাত্র দশ দিনের জন্য উন্মুক্ত ডাকের মাধ্যমে এ মেলার ইজারা দেওয়া হয়।   ইজারা পেয়েছেন বাঘা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মামুনুর রহমান। গত বছর মেলার ইজারা দেওয়া হয়েছিল ২৪ লাখ ৭০ হাজার টাকায়।

আব্বাসীয় বংশের হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহদৌলা (রহ:) ও তার ছেলে হযরত আবদুল হামিদ দানিসমন্দ (রহ:) এর সাধনার পীঠস্থান রাজশাহীর বাঘা। আধ্যাত্মিক দরবেশের ওফাত দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতরে আরবি শওয়াল মাসের ৩ তারিখে ধর্মীয় ওরস মোবারক উৎসবকে সামনে রেখে বাঘা ওয়াকফ এস্টেটের উদ্যোগে বিশাল এলাকা জুড়ে আয়োজন করা হয় এ মেলার।

শুরু থেকেই ঈদমেলায় নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। এখানে স্টলের সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বেচাকেনা চলছে গভীর রাত পর্যন্ত। পাওয়া যাচ্ছে রকমারি মিষ্টি, খেলনা, মনোহারি সামগ্রী, লোহা ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন আসবাবপত্র, মাটির তৈরি তৈজসপত্রসহ সদরঘাটের পান।

মেলাকে ঘিরে বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে আয়োজন করা হয়েছে- সার্কাস, মৃত্যুকূপ ও মোটরসাইকেল খেলা। এছাড়া বিভিন্ন খেলাধূলারও আয়োজন করা হচ্ছে। আর মেলা প্রাঙ্গণে ওরস মোবারককে ঘিরে সারারাত চলছে ভক্তদের জিকির, সামা কাওয়ালি। ভক্ত ও আগ্রহী মানুষরা এতে যোগ দিচ্ছেন।

প্রতি বছরই পাপ মোচন ও পূণ্য লাভের আসায় দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ বাঘায় আসেন পবিত্র ওরস মোবারকে অংশ নিতে ও মাজারে নামাজ আদায় করতে। তাই বাঘা ওয়াকফ এস্টেট কর্তৃপক্ষ এখন ব্যস্ত। সু-শৃঙ্খল আয়োজন বজায় রাখতে তাদের চেষ্টার অন্ত নেই।

শিল্প মহিমার বিস্ময়কর স্থাপত্য নকশার অনন্য নিদর্শন বাঘা শাহী মসজিদের ভেতরে প্রবেশ পথের উত্তরে বাঁদিকে হযরত শাহ মোয়াজ্জেম ওরফে শাহেদৌলা (রহ:) এর মাজার শরিফ। শাহী মসজিদের উত্তরে খানকা বাড়ির ভেতরে তার ছেলে হযরত শাহ আবদুল হামিদ (রহ:) এর মাজার শরিফ আছে।

তারা প্রায় ৫০০ বছর আগে সুদূর বাগদাদ থেকে পাঁচজন সঙ্গীসহ ইসলাম প্রচারের জন্য রাজশাহীর বাঘায় এসেছিলেন। তারা রাজশাহীর পূর্ব-দক্ষিণ কোণে পদ্মা নদীর কাছে কসবে বাঘা নামক স্থানে বসবাস শুরু করেন। নিজের চরিত্র মাধুর্য, ব্যবহার ও আধ্যাত্মিক শক্তি দিয়ে সাধারণ মানুষের হৃদয় জয় করেন। একপর্যায়ে ওই এলাকার জনগণের মধ্যে ইসলাম প্রচারে সাফল্য পান।

ধর্মীয় ওই ওরসকে কেন্দ্র করেই প্রতি বছর ঈদ-উল-ফিতরের মেলা বসে। বছরের পর বছর ধরে বাঘা ওয়াকফ এস্টেট পরিচালনা কমিটি ধর্মীয় আয়োজনে ওরস ও ঐতিহ্যবাহী এই ঈদমেলা পরিচালনা করে থাকেন।

নব্বই বছর পার করা রাজশাহীর বাঘার স্থায়ী অধিবাসী আরজ আলী প্রামাণিক জানান, মূলত ওরসকে কেন্দ্র করেই মেলার আয়োজন। এ অঞ্চলের মানুষের কাছে ঈদুল ফিতরের উৎসব মানেই বাঘার ‘ঈদমেলা’। বাঘা ও এর আশপাশের অনেকের বিয়ে হয়েছে ভারতে। বছরের সবসময় যাতায়াত না থাকলেও ঈদ-উল-ফিতরে বাঘার মেলাকে ঘিরে তারাও আসেন স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে।

তার বাবার কাছ থেকে শোনা গল্পের স্মৃতিচারণ করে আরজ আলী বলেন, একসময় বাঘার মেলাকে ঘিরে ভারত থেকে প্রচুর মানুষ আসত। ঈদের আগের দিন ভারত থেকে জামাইসহ মেয়েরা চলে আসত বাপের বাড়ি। মেলায় ঘুরে কিছুদিন থেকে সবার সঙ্গে ঈদ উদযাপন করে আবার ফিরে যেত। এখনও সেই ধারা অব্যাহত আছে। বাপ-মা অপেক্ষা করে ঈদ এলে তার মেয়ে বাপের বাড়ি আসবে।

বাংলার ঐতিহ্যবাহী আর্কষণ হলো পল্লীমেলা। বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেলার গন্ধ। কখনও ঋতু, কখনও কৃষি, কখনও নববর্ষ, কখনও ঈদকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মেলা। কিন্তু ঈদ-উল ফিতরের উৎসবকে কেন্দ্র করে এত বড় মেলা দেশের অন্য কোথাও হয় বলে জানা যায়নি।

বাঘা মাজার পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব খন্দকার মুনসুরুল ইসলাম রইস বাংলানিউজকে বলেন, ঈদমেলার জৌলুস প্রতি বছরই বাড়ছে। বাড়ছে লোক সমাগমও। মূলত: বছরের এই সময়টিতে মেয়ের পরিবারের লোকজন জামাইয়ের পরিবারকে ঈদ উৎসবের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন। মেলা দেখতে আসেন পর্যটকরাও। এতে মেলা যেমন লাখো মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়, তেমনি বাঘা ও আশপাশের অঞ্চলের পরিবারগুলোতেও স্বজনদের হাট বসে। যা ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

প্রসঙ্গত, প্রায় ৫০০ বছরের পুরনো ইতিহাস অনুযায়ী এখানে ছিল উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, এছাড়াও মাজার শরীফের পাশে আছে বিশাল এক দিঘী। বাঘা শাহী মসজিদের ছবি ৫০ টাকার নোটে প্রতিকৃতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ওরস ছাড়াও সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মনবাসনা পূরণের জন্য হাজার হাজার দর্শনার্থীর আগমন ঘটে বাঘা শাহী মসজিদ ও মাজার শরিফে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৫০ ঘন্টা, জুলাই ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।