রাজশাহী: গৃহকর্তীর নির্মম নির্যাতনে জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা শিশু গৃহকর্মী সোনিয়াকে (৯) বাঁচাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ৪সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে।
হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফ আলী সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে শনিবার দুপুরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের এক জরুরি মিটিং শেষে মেডিকেল টিম গঠনের বিষয়টি জানানো হয়।
অর্থপেডিক সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. বিকে দামকে প্রধান করে গঠিত মেডিকেল টিমের অন্য সদস্যরা হলেন, হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আসগার হোসেন, শিশুসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহ মোহাম্মদ আহসান শহীদ ও নিউরো সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রার শামসুজ্জামান সজল।
দুপুর পৌনে ২টায় সভা শেষে এক প্রশ্নের জবাবে হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফ বলেন, ‘আমি সকালে গিয়ে সোনিয়াকে দেখে এসেছি। সে ভালো আছে। ’
তিনি আরও বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে আজ বিকেলের মধ্যেই তাদেরকে রিপার্টে দিতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
শিশুটির চিকিৎসা ব্যয় কে বহন করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাসপাতালের পক্ষ থেকে ব্যয় নির্বাহ করা হচ্ছে। তবে হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, মেজর আশফাক এই ব্যয় বহন করছেন। এ ব্যাপারে মেজর আশফাক বা তার নির্যাতক স্ত্রী কলির কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।
হাসপাতালের ওসিসি (ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার) বিভাগের সমন্বয়ক ডা. গোপেন আচার্য্য জানান, সোনিয়ার আলট্রাসনোগ্রাম, এক্স-রেসহ বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। মেডিকেল বোর্ড এসব দেখে করণীয় নির্ধারণ করবেন।
তবে ওসিসির একটি সূত্র বাংলানিউজকে জানায়, সোনিয়ার হাত-মুখসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ফুলে গেছে এবং তস্থানগুলোতে ফুইড জমা হয়েছে।
এছাড়া লাথির আঘাতে ফুলে যাওয়া নাভির কাছে এখনও শক্ত হয়ে আছে। খাবার ঠিকমত নিতে পারছে না। তার অবস্থা এখনও আশংকাজনক।
উল্লেখ্য, শীত ঠেকাতে গায়ে মনিবের একটি কম্বল জড়ানোয় গত শনিবার (১২ ফেব্রুয়ারি) রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে সেনা কর্মকর্তা মেজর আশফাফের স্ত্রী কলি রড দিয়ে পিটিয়ে গৃহকর্মী সোনিয়ার একটি হাত ভেঙ্গে ফেলেন। তার নির্মমতায় কলির একটি চোখও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে আঁচড়ে-খামচে লাথি মেরেও শান্ত হননি তিনি। একপর্যায়ে শিশুটির গায়ে গরম পানি ঢেলে দেন এই মহিলা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এরপর সোনিয়াকে ওই অবস্থায় বাথরুমে আটকে রাখা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে মেজর আশফাক ঢাকা থেকে রাজশাহী ফিরে সোনিয়ার ভয়াবহ অবস্থা দেখেও নিজে জরুরি কোনও চিকিৎসার উদ্যোগ নেননি।
তবে তিনি শিশুটির চাচা ফরমান আলীকে মোবাইল ফোনে ডেকে পাঠান। এরপর ফরমান আলী ও সোনিয়ার মা শিউলি বেগম ওইদিন বিকেলে মেজর আশফাকের সেনানিবাসের বাসায় আসেন। চিকিৎসা ছাড়াই ওই রাতে মা ও চাচার সঙ্গে সোনিয়াকে গ্রামের বাড়ি গোদাগাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।
পরে ১৬ ফেব্রুয়ারি (বুধবার) রাতে আশংকাজনক অবস্থায় শিশুটিকে রামেক হাসপাতালের ওসিসি ইউনিটে ভর্তি করা হয়। এখন পর্যন্ত সে সেখানেই চিকিৎসাধীন রয়েছে। তবে প্রথম দিকে শিশুটিকে হাসপাতাল থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করা হয় বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। কিন্তু বিষয়টি মিডিয়ার নজরে চলে আসায় তা সম্ভব হয়নি।
এরপর শুক্রবার সকালে পুলিশ পাহারায় সোনিয়াকে হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে তখন হাসপাতালের এক কর্মী বলেন, ‘নগরীর লীপুর এলাকার পপুলার ডায়গনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ’
পরে একইভাবে দুপুর ১২টা ১৩ মিনিটে আবারো তাকে রামেক হাসপাতালের ওসিসিতে ফিরিয়ে আনা হয়। এ সময় সাদা চাদর দিয়ে তার আপাদমস্তক ঢাকা ছিল। ফলে বাইরের কেউই সোনিয়ার বর্তমান অবস্থা চোখে দেখতে পারেন নি।
এখন পর্যন্ত তার চিকিৎসা সেবার তথ্য নিয়েও চলছে লুকোচুরি খেলা।
এদিকে যোগাযোগ করা হলে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির রাজশাহী বিভাগীয় সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট দিল সেতারা চুনী বাংলানিউজকে জানান, সোনিয়ার বাবা নবাব আলী মামলা করতে রাজী থাকলেও ওকালতনামায় স্বার করতে রাজী হচ্ছেন না।
মহিলা আইনজীবী সমিতি মামলা করছে না কেন প্রশ্ন করলে তিনি জানান, এজন্য ঢাকা থেকে অনুমতি নিতে হবে।
এ ব্যাপারে কথা বলার জন্য রাজশাহী সেনানিবাসের একটি ট্রেনিং ব্যাটালিয়নে কর্মরত মেজর আশফাকের সেল ফোনে ১৭ ফেব্রুয়ারি বারবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি ফোন ধরলেও কথার শুরুতেই লাইন কেটে দেন কিংবা রিং হওয়ার পরও ফোন রিসিভ করেননি।
১৯ ফেব্রুয়ারি বিকাল ৪টার দিকে মেজর আশফাকের সেল ফোনে আবারও কল করা হয়। কিন্তু তিনি কল রিসিভ করেননি। পরে ল্যান্ডফোনে তার সেনানিবাসের বাসায় যোগাযোগ করা হয়। এবারও তিনি ফোন রিসিভ করার পর পরিচয় পেয়ে তা কেটে দেন। এরপর আবারো ফোন করা হলে ও প্রান্ত থেকে কেউ ফোন রিসিভ করেননি। তাই শিশু সোনিয়াকে নির্মম নির্যাতনের বিষয়ে মেজর আশফাক বা তার স্ত্রী কলির কোনও বক্তব্য জানা যায়নি।
বাংলাদেশ সময়: ১৬০৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০১১