ঢাকা, বুধবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ট্রান্সকমের রোষানলে পড়ে সর্বস্বান্ত ৪৩ পরিবার

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১০২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১১
ট্রান্সকমের রোষানলে পড়ে সর্বস্বান্ত ৪৩ পরিবার

ঢাকা: ট্রান্সকম গ্রুপের রোষানলে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছে শ্রীমঙ্গলের ৪৩টি পরিবার। অসহায় এসব পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জীবিকা নির্বাহের সব পথ।

বিগত সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এসব পরিবারকে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে ট্রান্সকম।

মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার উত্তর বৌলাছড়ার এসব পরিবারের ঠিকানা এখন টিলা বা পাহাড়ের ঘনজঙ্গল। কেউ মাটির ঘর বেঁধে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউবা ঠাঁই নিয়েছেন ছনের ঘরে।

যে পরিবারগুলো একসময় ছিল সাবলম্বী, ফসল ফলিয়ে তা বিক্রি করে সংসার চালাতেন, ছেলে মেয়েদের স্কুলে পড়াতেন। সেইসব মানুষ এখন অন্যের মুখাপেক্ষী। তারা এখন জমি-জিরেত হারা।

তার সঙ্গে বাড়তি যোগ হয়েছে পুলিশের তাড়া। সেকারণে ঘরছাড়া হয়েছেন এসব পরিবারের পুরুষরা।

বৌলাছড়ার এক টিলায় দেখা পাওয়া গেলো সর্বহারা কিছু পরিবারের সদস্যদের। ৫০ বছরের সুরুজ মিয়া মাটির একটি ঘর তৈরি করে সেখানেই স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বসবাস করছেন।

বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে তাকেও পরিবারসহ উচ্ছেদ করে ট্রান্সকম। বাপ দাদার ভিটা বাড়ি সবই দখল নেয় তারা। শুধু তাই নয়, লেবু, আম, জাম, কাঠাল গাছের বাগানও গ্রাস করে নেয় ট্রান্সকম গ্রুপ।

সব হারানো এই সুরুজ মিয়া যখন প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, ট্রান্সকম কর্তৃপ পুলিশ দিয়ে তাকে ভয়ভীতি দেখায়। তিনি বাধ্য হন, তাদের কথা মত কাজ করতে। সেই সুরুজ মিয়া এখন তার বেদখল হয়ে যাওয়া জমিরই চৌকিদার।

সুরুজ মিয়া জানান, ট্রান্সকম গ্র“প তাদের চা বাগানের জন্যে জমিজমা দখল করে নিয়েছে। ১৯২০ সালে তার দাদা ওই জমিতে বসতি স্থাপন করেন। ১৯২৭ সালে জমিদারের কাছ থেকে জমির বন্দোবস্ত পান তারা। তখন থেকে তারা বংশ পরম্পরায় সেখানে বসবাস করছেন। তার বাবা মনু মিয়া ছিলেন কৃষক। বাবার কাছ তিনি পেয়েছিলেন ৩ সহস্রাধিক গাছের বিভিন্ন ফলের বাগান। এছাড়া তার ছিল লেবু বাগান।

অতীতের দিনগুলো স্মরণ করে সুরুজ মিয়া বলেন, প্রতিদিন গাড়িভর্তি করে নিয়ে লেবু বিক্রি করতেন। সপ্তাহে পান বিক্রি হতো ৩ হাজার টাকার। প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকার ফল বিক্রি করতেন।

কিন্তু আজ সবকিছুই তাদের হাতছাড়া। দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যমের মালিক লতিফুর রহমানের সাইফ টি এস্টেট নিজেদের জমি থেকে তাদের বিতাড়িত করে।

অন্য পাশেই ঘর বানিয়ে থাকেন হারেজ আলী। সুরুজ মিয়ার চাচাতো ভাই। তার জমিজমা, ভিটা বাড়ি সবকিছুই এখন ট্রান্সকমের অবৈধ দখলে। দখলে নিয়েছে। প্রতিবাদ করাতে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করা হয় তাকে। স্ত্রী সন্তান নিয়ে সেখানেই দুটি ছোট খুপরি ঘর বানিয়ে দিন গুজরান করছেন তারা।
 
৬৫ বছরের মকদ্দস আলী। এক সময়ের কৃষক এই বৃদ্ধ এখন পরিবহন শ্রমিক। তিনি ওই টিলাতে থাকতে পারেন না। পুলিশ তার পিছু ছাড়ে না। বৃদ্ধ মকদ্দস আলী জানান, তার জমি জমা কেড়ে নেওয়ার পর প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু ট্রান্সকমের সাইফ টি এস্টেট কর্তৃপ তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেছে। একটি অস্ত্র, আরেকটি চাঁদাবাজির অভিযোগ আনা হয়। দুটি মামলাতেই তাকে দু’বার জেলে যেতে হয়েছে।

তিনি বলেন, তাদের পে কথা বলার কেউ নেই। যিনি কথা বলছেন, তার বিরুদ্ধেই ট্রান্সকম মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে।
 
এদের মতো মানবেতর জীবন যাপন করছেন সুরুপ মিয়া, আহমদ মিয়া, মানিক মিয়া, ফারুক, সফর, কুতুবউদ্দিন, বারেক, সাবান মিয়া, ময়না মিয়া, আরিফুলাহসহ মোট ৪৩ জনের পরিবার। এরা প্রত্যেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

সর্বহারা এসব পরিবারের শিশুরা এখন আর লেখাপড়া করতে পারে না। নারীদেরও ছুটতে হচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে। পুরুষদের কেউ কাজ পেলে খাবার জুটছে, না পেলে অভুক্তই থাকতে হচ্ছে তাদের।
 
এসব পরিবারকে আইনি সহায়তাদানকারী আইনজীবী কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী জানান, অসহায় এসব পরিবারকে অবৈধ ভাবে উচ্ছেদ করেছে ট্রান্সকম। ১৯২৭ সাল থেকে এসব পরিবারের সদস্যরা বংশ পরম্পরায় এখানে বসবাস করে আসছিলেন। আইন অনুযায়ী কোনোভাবেই তাদের উচ্ছেদ করার এক্তিয়ার কারোর নেই।

কামাল উদ্দিন জানান, জমিদারের কাছ থেকে নেওয়া জমি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত দলিলপত্র এদের রয়েছে। দলিল থাকুক আর নাই বা থাকুক, তাদের কোন অবস্থাতেই উচ্ছেদ করা যাবে না। যদি তা কেউ করেন, তা হবে সম্পূর্ণ বেআইনি। কেননা আইনে আছে, ৬০ বছরের বেশি কেউ কোনো জমিতে অবস্থান করলে সেখান থেকে তাদের আর উচ্ছেদ করা যাবে না।

বাংলাদেশ সময় ২০৪৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৭, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।