ঢাকা: রাজশাহীর পুঠিয়ার মঙ্গলপাড়া গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক। এসএসসি পাশ করে আর পড়াশুনা হয়নি।
২০১৩ সালের মধু নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় ঘটে তার। মধু জানায় দোকান করে আর কত টাকাই লাভ হয়। তার চেয়ে বরং বিদেশে গিয়ে অনেক বেশি লাভবান হতে পারবেন। মাসে কামাতে পারবেন কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা। শুধু দালালের মধুর কথায় বিদেশ যাওয়ার ইচ্ছা জাগে রাজ্জাকের।
বাবা-মার অনুমতি না থাকলেও এক পর্যায়ে ভাগ্য বদলানোর আশায় ৭ লাখ টাকা খরচ করে ইরান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন রাজ্জাক। মধুর কথায় বিশ্বাস করে টাকা দিয়ে গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ইরানে পাড়ি জমান রাজ্জাক।
যাওয়ার একদিনের মাথায় তিনি বুঝতে পারেন ভাগ্য বদলানোর যে আশা নিয়ে তিনি ইরানে এসেছেন তা আসলে ভুল। দালালের পাল্লায় পড়েছেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যে কি আছে তখনও বুঝে উঠতে পারেননি রাজ্জাক। অনেকের সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় গহীন জঙ্গলের ভেতর।
এরপর শুরু হয় শারীরিক নির্যাতন। টাকা কামানোর আশায় বাবা-মার সহায় সম্বল জায়গা জমি বিক্রি করে দেশ পেরিয়ে আসা। নির্যাতনে মুহূর্তে মনে পড়ে যায় বাবা-মার অসম্মতির কথা। নির্যাতনের এক পর্যায়ে বলে ৫ লাখ টাকা লাগবে না হলে ছাড়বো না। প্রাণে মেরে ফেলা হবে।
রাজ্জাক তার দূর্দশার কথা জানায় বাবা-মাকে। পরিবারের দুই ছেলের মধ্যে ছোট ছেলে হওয়াতে তার এমন দুর্দিনে বাবা-মা জানায় আমরা ২ লাখ টাকা দিতে পারবো। পরে ২ লাখেই মুক্তি মেলে রাজ্জাকের।
গত ৩০ এপ্রিল ইরান থেকে তৃতীয় ধাপে যে ২২ জনকে আনা হয়েছে রাজ্জাক তার মধ্যে একজন।
রাজ্জাক বাংলানিউজকে জানান, এক সপ্তাহ তারা ওই জঙ্গলের মধ্যে তার মত প্রায় ২০জনকে নিয়ে এসে নির্যাতন করেছে। সারাদিন একটি রুটি আর পানি খাইয়ে রাখত। টাকা না দিলে তাদের মুক্তি দিতনা।
তৃতীয়ধাপ ৩০ এপ্রিল যে ২২জন দেশে এসেছেন তারা সবাই মুক্তিপণ বাবদ টাকা দিয়েই মুক্তি নিয়েছেন। টাকা পাওয়ার পর তারা দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। পরে দেশে ফেরে।
রাজ্জাকের মতই প্রতারণার শিকার জামালপুর সদরের আমিনুল ইসলাম। বিদেশে গিয়ে টাকা কামিয়ে আর্থিক স্বচ্ছলতার আশায় নিয়ে তিনিও ইরান গিয়েছিলেন। কিন্তু দালালদের খপ্পড়ে পড়ে সেও দেশে ফিরে এসেছে। মুক্তিপণ বাবদ তিনিও ২ লাখ টাকা দিয়ে এসেছেন।
নোয়াখালী সদর থানার আরমান হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, ইরানে শ্রমিক হিসেবে গেলে তাকে ৫০ হাজার বাংলাদেশি টাকা বেতন দেওয়ার আশ্বাস দেয়। আর এ কারণে মূলত টাকার লোভেই ৫ লাখ টাকা খরচ করে ইরান যায়। কিন্তু এখন আমরা নি:স্ব। গত দুই তিনমাস ধরে তাদের নির্মম নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে।
আরমান বলেন, আমরা যারা গিয়েছিলাম সকলেই আজ নি:স্ব। কেননা জায়গা জমি বিক্রি করে বিদেশ গিয়েছিলাম। আজ খালি হাতে হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। এখন আমার আছে বসত ভিটেবাড়ি টুকু। এছাড়া আর কিছুই নাই।
দেশে যে সব দালাল এ ধরনের কাজ করছে তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন তিনি।
ইরানে অপহরণের শিকার হয়ে আরও প্রতারিত হয়েছেন, রাজবাড়ী পাংশার রুহুল আমিন, মেহেরপুরের গাংনির জিনারুল ইসলাম, চাঁদপুরের আবু সাঈদ খাঁন, জামালপুরের আমিনুল ইসলাম, টাঙ্গাইল জেলার দেলু, একই জেলার আমিনুর ইসলাম, বগুড়া জেলার রফিকুল ইসলাম, নোয়াখালীর আরমান হোসেন, যশোরের আক্তারুজ্জামান, বাগেরহাটের আতাউর রহমান, কিশোরগঞ্জের কামরুল হাসান, গোপালগঞ্জের আকরাম ফকির, নরসিংদীর সোহেল মিয়া, কুষ্টিয়ার আকমল হোসেন, মেহেরপুরের তাহাজ উদ্দীন, টাঙ্গাইলের নজরুল ইসলা, নওগাঁর মামুনুর রশিদ, একই জেলার শহিদুল, রাজশাহীর রহিদুল ইসলাম, মেহেরপুরের শাহিন, টাঙ্গাইলের সালাউদ্দীন, তমিজ উদ্দীন, জিল্লুর রহমান, রমিজ আলী, মহসিন, সোহরাব, হৃদয় আলী সাহাবুদ্দিন, সামার উদ্দীন, হালিম, ফরহাদ হোসেন, মেহেদী হাসান, মন্তাজ মিয়া, মাহফুজুর রহমান, শফিকুল ইসলাম, শফিকুল আলম, সজিব চন্দ্র নাথ, ফিরোজ মিয়া, আমিনুল হক, জুয়েল মিয়া, মহসিন মিয়া এবং জাকির হোসেন।
মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কর্মরত শ্রমিক ও বাংলাদেশের কিছু অঞ্চলের লোকজনকে অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে ইরান, গ্রিসসহ কয়েকটি দেশে শ্রমিক হিসেবে পাঠানোর নাম করে প্রতারণা করা হচ্ছে।
সম্প্রতি এ ধরনের প্রতারণার শিকার প্রায় ৮০ বাংলাদেশিকে ইরান থেকে ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সিআইডি। ইতোমধ্যে তৃতীয়ধাপে ৩০ এপ্রিল ৪৩ জনকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। বাকিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
প্রথম পর্যায়ে ১৭ এপ্রিল ১২ জন, দ্বিতীয় ধাপে ২৫ এপ্রিল ৯ জন এবং ৩০ এপ্রিল আরো ২২ জনকে ফিরিয়ে আনা হয়।
সিআইডির অতিরিক্ত ডিআইজি মো. শাহ আলম বাংলানিউজকে বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, দুবাই ও ওমানে কিছু কয়েকটি বাংলাদেশি প্রতারক গ্রুপ রয়েছে। এরা সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশি এক শ্রেণির শ্রমিকদের টার্গেট করে ইরান, গ্রিস এবং তুরস্ক নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখায়। তারা বলে সেখানে মাসে ৫০ হাজার টাকা আয় হবে। থাকা, খাওয়া কোম্পানির।
এমন লোভনীয় কথায় শ্রমিকরা বিশ্বাস করে সেখানে যায়। কিন্তু যাওয়ার পথে আরব সাগরের মধ্যে তাদের জাহাজ থেকে নামিয়ে স্পিড বোডে উঠানো হয়।
তিনি বলেন, ইরানের বন্দর আব্বাস পার হয়ে তাদের নিয়ে যায় জঙ্গলের মধ্যে। এরপর সেখানে তাদেরকে ৫/১০ লাখ টাকা পর্যন্ত মুক্তিপণ দাবি করা হয়। যারা মুক্তিপণের টাকা দিতে পারেন তারা টাকা দিয়ে দেশে ফিরে আসেন। আর যারা টাকা দিতে পারেন না তাদের অমানুষিক নির্যাতন চালায়।
অতিরিক্ত ডিআইজি শাহ আলম বলেন, এ বিষয়ে ইরান পুলিশের সহায়তা নিয়ে সিআইডি ইতিমধ্যে তাদের কাজ শুরু করেছে। এমনকি এ ধরনের প্রতারণা ঠেকাতে সিআইডির টিম ইতিমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ও ইরান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
তারা এই এ সকল স্থানে গিয়ে এই চক্রের জড়িতদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা করছে। এছাড়াও যারা প্রতারিত হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন তারাও যাদের মাধ্যমে প্রতারণার শিকার হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা হবে। আর সেই মামলাগুলো সিআইডি তদন্ত করবে।
তিনি বলেন, এই চক্রকে গ্রেফতার করতে সিআইডি চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২৫২ ঘণ্টা, মে ০৪, ২০১৪