ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মৌলভীবাজারে জমি দখল করে ট্রান্সকমের চা বাগান

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৫৮ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১১
মৌলভীবাজারে জমি দখল করে ট্রান্সকমের চা বাগান

সিলেট: এবার শিল্পপতি লতিফুর রহমানের মালিকানাধীন ট্রান্সকম গ্রুপের বিরুদ্ধে হুমকি-ধামকি প্রদর্শন আর বল প্রয়োগের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জমি অবৈধ দখল করে চা বাগান গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

সেনা সমর্থিত বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রশাসনে প্রভাব বিস্তার করে মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের উত্তর বৌলাছড়ায় প্রায় ৭০ একর জমি দখল করে নেয় ট্রান্সকম গ্র“পের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘সাইফ টি এস্টেট’।



জমি দখলের সময় শতাধিক পরিবারকে তাদের বাপ দাদার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়। দখলের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পুরুষ সদস্যরা পুলিশ ও ভাড়াটে সন্ত্রাসীদের ভয়ে দীর্ঘদিন ধরেই এলাকা ছাড়া।

ট্রান্সকমের রোষানলের শিকার জমির মালিকদের মধ্যে ষাটোর্ধ বৃদ্ধকেও অস্ত্র ও চাঁদাবাজির অভিযোগে দু’বার জেল খাটতে হয়েছে। এ অবস্থায় বাগানের আশপাশের বাসিন্দারাও রয়েছেন আতঙ্কে। ট্রান্সকমের লোলুপ দৃষ্টি তাদের জমির ওপরও পড়তে পারে এমন আশঙ্কায় তারা দিন কাটাচ্ছেন।  

স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, ট্রান্সকম গ্রুপ সাইফ চা বাগানের সীমানা বাড়াতে সংলগ্ন জমি মালিকদের শুধু উচ্ছেদ করেই ক্ষান্ত হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের করে হয়রানি করছে।

বাস্তুভিটা ও ভূ-সম্পত্তি থেকে সাধারণ মানুষকে তাদের বাপ দাদার ভিটা থেকে অবৈধভাবে উচ্ছেদ করে ট্রান্সকম গ্রুপ। শিশু নারী ও পুরুষদের বের করে দিয়ে সেই সব ঘরবাড়ি এখন বাগান কর্মকর্তাদের দফতর, শ্রমিক কলোনি, গুদাম হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

তারা শুধু জমি দখলই নয়, গ্রামবাসীদের জীবন জীবিকার মাধ্যম লেবু, আম, জাম, কাঠালসহ বিভিন্ন ফলের বাগান দখল করে নিজেদের সীমানার অর্ন্তভুক্ত করেছে। সব হারানো এ ধরণের শতাধিক পরিবার এখন মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিভিন্ন স্থানে ছন পাতার অস্থায়ী ঘর তুলে তারা এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে।
 
জানা গেছে, মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মির্জাপুরের উত্তর বৌলাছড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে ট্রান্সকম গ্রুপের চা বাগান ‘সাইফ টি এস্টেট’।

১৯৬৫ সালের ২৮ জুন সরকার থেকে সাড়ে ৮ শ’ একর জমি ৯৯ বছরের লিজ নিয়ে শুরু হয় এই চা বাগানের কার্যক্রম। জমির লিজের মেয়াদ শেষ হবে ২০৬৫ সালের ২৭ জুন।
 
স্থানীয় বাসিন্দা ও অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, লিজ নেওয়া জমির পশ্চিম দিকে ২৪ দাগের ৭০ একর জমি রয়েছে। এই ৭০ একর জমিতে শতাধিক পরিবার বসবাস করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এদের মধ্যে ৪৩টি পরিবার বংশ পরম্পরায় ১৯২৭ সাল থেকে ওই জমিতে বসবাস করছেন।

তাদের পূর্ব পুরুষরা গয়াসনগর পরগনার জমিদারির অর্ন্তগত এই ভূমি খিরাজি পাট্টামূলে জোর বন্দোবস্ত নিয়ে বসতি স্থাপন শুরু করেন। তারা এই ৭০ একর জমিতে লেবু, আম, জাম, কাঠালের বাগান গড়ে তোলেন। এছাড়াও তেজপাতা, বাঁশবাগান এবং পানের বরজও ছিল। এসব বিক্রী করেই এরা মূলত জীবিকা নির্বাহ করতেন।

কিন্তু ‘সাইফ টি এস্টেট’ প্রতিষ্ঠার পর তারা নানা হয়রানির শিকার হতে থাকেন। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সাইফ চা বাগান কর্তৃপরে হয়রানির পরিমান মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। তারা জমির মালিকদের জোর করে উচ্ছেদ শুরু করে। নিরীহ গ্রামবাসীর জমি গ্রাস করে নেয়।
 
ভূমি হারানো আজর উল্লাহ জানান, তার বাপ দাদার ভিটা দখলের চেষ্টা শুরু হয় ৮০ দশকের শেষ দিকে। বিভিন্নভাবে সাইফ টি এস্টেট এর পক্ষ থেকে হয়রানি করা হলেও ২০০০ সালের পর এর মাত্রা বেড়ে যায়। সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়েও বাসিন্দাদের নির্যাতন করানো হয়। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন বা অন্য কেউ সাহায্যে এগিয়ে আসেনি।

অবৈধ উচ্ছেদের জন্য বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলকেই বেছে নেয় টি এস্টেট কর্তৃপক্ষ। সেসময় কেউ বুঝে ওঠার আগেই পুলিশ ও সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সাইফ টি এস্টেট’র লোকজন। তারা প্রতিটি ঘর থেকে লোকজন বের করে দেয়। গোটা এলাকায় কায়েম করে ত্রাসের রাজত্ব।

আজর উল্লাহ জানান, পুলিশ প্রশাসনও তাদের কথা মতো কাজ করেছে। তাদের জন্যে যারা এগিয়ে আসবেন, সেই সব স্থানীয় লোকজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। পুলিশ দিয়ে তাদের আগেই এলাকা ছাড়া করা হয়।

তিনি আরও জানান, তার বাপ চাচারা যে বাগান করেছিল, তার অংশ বিশেষ এখনো সেখানে রয়েছে।

৬৫ বছরের মকদ্দস আলী এই বয়সেও চাঁদাবাজির অভিযোগে দু’বার জেল খেটেছেন। সাইফ টি এস্টেট কর্তৃপ তার ভিটা বাড়ি জমি শুধু দখলই করেনি, প্রতিবাদ করায় একের পর এক মামলা করেছে। পুলিশ দিয়ে পাকড়াও করে জেল খাটিয়েছে।

মকদ্দস আলী জানান, লতিফুর রহমান তার চা বাগানের সীমানা বাড়ানোর জন্যে সাধারণ লোকজন উচ্ছেদ করে জমি দখল করে নিয়েছেন। তারা শুধু প্রশাসনই নয়, স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদেরও টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছে। অবৈধভাবে দখল করে নেওয়া ৭০ একর জমি ফিরে পেতে তারা আদালতের শরনাপন্ন হয়েছেন।

তিনি জানান, যাদের উচ্ছেদ করে মামলা দেওয়া হয়েছে, তাদের প্রত্যেকেই মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া সুরুপ মিয়া, আহমদ মিয়া, মানিক মিয়া, ফারুক, সফর, কুতুবউদ্দিন, বারেক, আরিফুল্লাহসহ প্রত্যেকেই পরিবার পরিজন নিয়ে এখন অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। এদের প্রত্যেকের মাথার ওপর ঝুলছে মিথ্যা মামলার খড়গ।

উত্তর বৌলাছড়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার মনু মিয়ার বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে চাঁদাবাজি ও অস্ত্র রাখার অভিযোগে। তার অপরাধ, জরুরি অবস্থায় জমি হারানোদের পক্ষে ছিলেন।

মনু মেম্বার জানান, লতিফুর রহমান নিজের মালিকানাধীন প্রথম আলো পত্রিকার প্রভাব খাটিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকে তার পক্ষে নিতে বাধ্য করেছেন। আর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থার সময়কে বেছে নিয়ে সম্পূর্ণ অবৈধভাবে শতাধিক অসহায় পরিবারকে বাপ দাদার ভিটেমাটি থেকে জোরপূর্রক উচ্ছেদ করে বাগানের সীমানা বাড়িয়ে নেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০১১

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।