ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

মূল স্রোতে আসছে কওমি মাদ্রাসা, মিলছে স্বীকৃতি

সাখাওয়াত কাওসার | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২২৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৩
মূল স্রোতে আসছে কওমি মাদ্রাসা, মিলছে স্বীকৃতি

ঢাকা: অবশেষে স্বীকৃতি মিলছে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার মূল স্রোতে প্রবেশ করার মাধ্যমে এসব শিক্ষার্থীরা খুব শিগগিরই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরি কিংবা প্রতিযোগিতামূলক যে কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন।

ইসলামি ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এখন থেকে সরাসরি দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারবেন। এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত ‘বাংলাদেশ কওমী মাদ্রাসা শিক্ষা কতৃপক্ষ’ নামে আইনের খসড়াও তৈরি করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রী পরিষদের সর্বশেষ গত সোমবারের বৈঠকেই খসড়াটি আইনে রূপান্তরিত হওয়ার কথা ছিলো। প্রধানমন্ত্রী খসড়ার কয়েকটি বিষয়ে সংশোধনীর জন্য ফেরত পাঠান। দেশের প্রখ্যাত আলেমদের মতামতের ভিত্তিতে এর সংশোধনের পর আগামী বৈঠকেই তা পাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ সাংবাদিকদের জানান, সরকার কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশনের দেয়া প্রস্তাবনা অনুযায়ীই সরকার এ ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। হেফাজতে ইসলামের আমীরের নেতৃত্বাধীন কমিশনের সুপারিশের আলোকেই কওমি শিক্ষার্থীদের সনদের স্বীকৃতি দিতে এই কর্তৃপক্ষ গঠন করা হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, আলেম-ওলামাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কওমি মাদ্রসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ গঠন করে শিগগিরই তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে। কওমি মাদ্রাসা নিয়ে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত কওমি মাদ্রাসার আলেম-ওলামারাই নেবেন বলে শিক্ষানীতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে বলে জানান নাহিদ।

আইনের খসড়ায় যা রয়েছে:
কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কতৃপক্ষের কার্যালয় ঢাকায় থাকবে। কর্তৃপক্ষে একজন চেয়ারম্যান, নয়জন সদস্য থাকবেন। এর মধ্যে সাতজন কওমি শিক্ষা ক্ষেত্রে শীর্ষস্থানীয় আলেম, যুগ্ম-সচিব কিংবা তদুর্ধ্ব পদমর্যাদার একজন সদস্য এবং নারী কওমি মাদ্রাসার একজন প্রতিনিধি। কর্তৃপক্ষ একজন সচিব নিয়োগ দেবেন। চেয়ারম্যান অন্যান্য সদস্য চার বছরের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত হবেন। চেয়ারম্যান অথবা কোনো সদস্যের প্রতি কর্তৃপক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য অনাস্থা প্রকাশ করলে সরকার তাকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রদান করতে পারবেন।
 
আবার চেয়ারম্যনের পদ শূন্য হলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তিনি দায়িত্ব পালন করতে অসমর্থ হলে শূন্য পদে নবনিযুক্ত চেয়ারম্যান দায়িত্বভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কর্তৃপক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে মনোনীত কোনো সিনিয়র সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন।

বেফাকুল মাদারিস বাংলাদেশ, ইত্তেহাদুল মাদারিস চট্টগ্রাম, এদারায়ে তা’মীল সিলেট, তানযীমুল মাদারিস উত্তরবঙ্গ, গওহরডাঙ্গা বেফাক বোর্ড ফরিদপুর এই পাঁচটি বোর্ডের প্রধান/সচিবরা পদাধিকার বলে কর্তৃপক্ষের সদস্য হবেন।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কর্তৃপক্ষ ইবতিদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (এসএসসি), সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ (এইচএসসি) স্তুরের শিক্ষা কার্যক্রম, সনদ প্রদান এবং এফিলিয়েটিং অথরিটি হিসেবে পাঁচটি শিক্ষা বোর্ডের মাধ্যমে তা পরিচালনা করবে।   তবে কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত কওমি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাই কেবল সনদ লাভের যোগ্য হবেন।

পৃথক কওমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত কর্তৃপক্ষ মারহালাতুল ফযিলত (স্নাতক সম্মান) এবং মারহালাতুত তাকমিল (দাওরা-ই-হাদিস-স্নাতকোত্তর) দুইটি স্তুরের শিক্ষা কার্যক্রম এবং সনদ প্রদানকারী অথরিটি হিসেবে কাজ করবে।

এছাড়াও এই কতৃপক্ষ বিধিমোতাবেক কওমি মাদ্রাসা স্থাপন, প্রয়োজনীয় ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করবে। মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য যুগোপযোগী পাঠ্যক্রম নির্ধারণ করবে। জ্ঞানের বিকাশ, বিস্তার ও অগ্রগতির লক্ষ্যে শিক্ষাদান ও গবেষনার ব্যবস্থা করবে। শিক্ষকদের বুনিয়াদী , চাকুরিকালীন এবং বিষয়ভিত্তিক প্রাগ্রসর জ্ঞানের প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করবে। শিক্ষার উন্নয়নের স্বার্থে দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের বাইরের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিখ্যাত কোনো মাদ্রাসার সঙ্গে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা এবং যৌথ একাডেমিক কার্যক্রম গ্রহণ করবে।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, দেশে সরকারনিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন আলিয়া মাদ্রাসার বাইরে প্রায় ২৫ হাজার কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। তবে এসব মাদ্রাসায় কত সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই। বেসরকারিভাবে পরিচালিত এসব কওমি মাদ্রাসা মূলত ভারতের দেওবন্দ মাদ্রাসার পাঠ্যক্রম অনুসরণ করে থাকে। তবে জামায়াতপন্থী কিছু আলেমের নেতিবাচক ভূমিকার কারণে এতোদিন কওমি মাদ্রাসাগুলোকে এক ছাদের নিচে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। এখনও জামায়াত-শিবির নেপথ্য থেকে কিছু মাদ্রাসার কতৃপক্ষকে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কতৃপক্ষের অধিভুক্ত না হওয়ার জন্য প্ররোচনা অব্যাহত রেখেছে। যেসব মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের অধিভুক্ত হবে না সেসব মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা সনদের স্বীকৃতি পাবে না।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, কওমি নেছাব অনুসরণ করেই কওমি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম প্রস্তুত করবে। তবে ইবতিদাইয়্যাহ (প্রাথমিক), মুতাওয়াসসিতাহ (নিম্ন মাধ্যমিক), সানাবিয়্যাহ আম্মাহ (এসএসসি), সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ (এইচএসসি) পর্যন্ত প্রতিটি স্তুরেই বাংলা, ইংরেজি, গণিত বাধ্যতামূলক বিষয় হিসেবে রাখা হচ্ছে। মুতাওয়াসসিতাহ ও সানাবিয়্যাহ আম্মাহ স্তুরে পর্যায়ক্রমে সমাজ বিজ্ঞান, সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার, ভূগোল, কৃষি ও গার্হ্যস্থ বিজ্ঞান বিষয় অন্তুর্ভুক্ত হবে। সানাবিয়্যাহ খাস্সাহ স্তুরে যুক্তিবিদ্যা, রাষ্ট বিজ্ঞান, ইতিহাস বিষয়টি রাখা হচ্ছে।

প্রতিবাদ
তবে এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় কওমি মাদ্রাসা আইন পাশের উদ্যোগের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম।

এ ব্যাপারে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক একেএম শহীদুল হক বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে কওমী মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা স্বীকৃতি চেয়ে আসছিলো। দেশের প্রখ্যাত আলেমদের নিয়ে গঠিত কওমি কমিশনের সুপারিশেই আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
 
তিনি আরো বলেন, এখন যারা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছেন তারা না বুঝেই করছেন। তবে কিছু দিনের মধ্যেই তাদের ভুল বুঝতে পারবেন। আলেমদের ওপর সরকারের হস্তক্ষেপের কোনো সুযোগ নেই। এটি বর্তমান সরকারের একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। কওমি মাদ্রাসার ইতিহাসে এটি মাইলফক হয়ে থাকবে।

প্রেক্ষাপট
বিগত চার দলীয় জোট সরকারের সময় থেকেই কওমি মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা তাদের সনদের স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। বর্তমান সরকার গত বছরের ১৫ এপ্রিল কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে বেফাকের সভাপতি ও চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার মহাপরিচালক ও হেফাজতে ইসলামীর আমীর শাহ আহমদ শফীকে চেয়ারম্যান করে ১৭ সদস্যের কমিশন গঠন করে। এই কমিশনের কো-চেয়ারম্যান হন শোলাকিয়া ঈদগাহের খতিব ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। আর সদস্য সচিব করা হয় গোপালগঞ্জের গওহরডাঙা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ রুহুল আমীনকে। কিন্তু এই দুই জনকে সরকারসমর্থক বলে অভিযোগ করেন কমিশনের অন্য আলেমরা। পরবর্তীতে কো-চেয়ারম্যান-১ পদে মাওলানা আশরাফ আলীকে ও সদস্য সচিব পদে আবদুল জব্বারের নাম দিয়ে কমিশন পুনর্গঠন করার দাবি জানান আহমদ শফী। একই সঙ্গে বেফাকের নামে কওমি সনদের স্বীকৃতি দেয়া বেফাককে অ্যাফিলিয়েটিং বিশ্ববিদ্যালয় করা, সরকারি অনুদান গ্রহণ না করা ও কওমি মাদ্রাসার পাঠপদ্ধতি পরিবর্তন না করাসহ আটটি প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি।

সরকারের সঙ্গে দুটি বৈঠকের পরেও এসব দাবি পূরণ না হওয়ায় আহমদ শফী কাউকে কিছু না জানিয়েই কমিশন থেকে ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে এই কমিশন গত ১৩ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ‘কওমী মাদ্রাসা শিক্ষানীতি ২০১২’ হস্তান্তর করেন।

এর আগে তারা ২০ মার্চ শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের সভাকক্ষে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাসচিব, অতিরিক্ত শিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে খসড়া নীতিমালা বিষয়ক মতবিনিময় করেন।

বাংলাদেশ সময়: ২২১৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৩
এসএফআই/আরকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।
welcome-ad