ঢাকা, শনিবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

২০১০: নগরীতে বছরের আলোচিত-সমালোচিত আত্মহত্যা

মুরসালিন হক, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩১৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০
২০১০: নগরীতে বছরের আলোচিত-সমালোচিত আত্মহত্যা

ঢাকা: ২০১০ সালে রাজধানীতে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে।   যা ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে।

এর মধ্যে সর্বাধিক আলোচিত হয় সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যার বেশ কয়েকটি ঘটনা। এসব আত্মহত্যা কখনো হয়েছে বিষপানে, কখনো ট্রেনের নীচে ঝাপ দিয়ে, আবার কখনো গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে। জুড়াইন, দক্ষিণ কমলাপুর, বনানী রেল ক্রসিং, পল্লবী এলাকায় সন্তানসহ মায়ের আত্মহত্যার এসব ঘটনার পাশাপাশি ছিল দক্ষিণ গোড়ান এলাকায় আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টাকারি পুত্রকে বাঁচাতে গিয়ে মা-ছেলে মৃত্যুর ঘটনাও।

ঘটনা ১: চলতি বছরের ১২ জুন সকাল থেকেই পুরো দেশ বিশেষ করে রাজধানীবাসী মুখর হয়ে ওঠেন চরম সমালোচনায়। কারণ এর আগের দিন ১১ জুন কদমতলী থানাধীন জুড়াইন আলমবাগ এলাকায় সন্তানসহ বিষপানে আত্মহত্যা করেছেন এ অসহায় মা।

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে মেনে নিতে না পারা, স্বামীর নির্যাতন অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের চরম অবহেলা জীবনের প্রতি এনে দিয়ে অনীহা। অন্ততপক্ষে আলমবাগের বাসার শয়নকক্ষে এ ধরনের কথাই লেখা ছিল। ফলে ছেলে কবির ইশরাত পাবন (১৩) এবং মেয়ে রাইসা রেশমি পায়েলকে (১১) সঙ্গে নিয়ে ১০জুন রাতে অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ সেবন করে আত্মহত্যা করেন অসহায় মা ফারজানা কবির রীতা (৩০)।

পুলিশ তাদের তিনজনের মৃতদেহ পরদিন শয়নকক্ষের বিছানা হতে গায়ে চাদর জড়ানো অবস্থায় উদ্ধার করে। এ সময় ঘরের দেয়ালে দুই সন্তান পবন ও পায়েলের লেখা তাদের বাবার কাছ থেকে পাওয়া চরম অবহেলার ঘটনা পড়ে চোখে জল এসে পড়ে উপস্থিত সকলের।

এ ঘটনায় নিহত রিতার মা মাজেদা বেগম বাদী হয়ে ১২ জুন কদমতলী থানায় আত্মহত্যায় প্ররোচিত করার অভিযোগে শিশু ও নারী নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় রিতার স্বামী রাশেদুল কবির (৪৫), শ্বশুর শফিকুল কবির (৭০), শাশুড়ী নূর বানু কবির (৬০), ননদ কবিতা কবির (৩৬), ননদের স্বামী দোলোয়ার হোসেন (৪২), ননদ সুকন কবির (৩২), গাড়ি চালক আল আমিন (২৬) ও রাশেদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা স্মৃতি।

এ ঘটনায় পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করলেও পরবর্তীতে শুধুমাত্র রিতার স্বামী রাশেদুল কবির (৪৫) এবং রাশেদুলের দ্বিতীয় স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা স্মৃতিকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতে পাঠায়। এছাড়াও ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাসার গাড়িচালক এবং ওষুধের দোকানদারকেও জেলহাজতে পাঠানো হয়।

ঘটনা ২: রিতা আত্মহত্যা ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর দক্ষিণ কমলাপুরে ঘটে যায় আরেকটি মর্মান্তিক ঘটনা। ৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুই সন্তানসহ আত্মহত্যা করেন আরেক মা।

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে করার ক্ষোভে ও শোকে বিলাসী আক্তার (২৭) নামে ওই গৃহবধূ তার ছেলে আবু রায়হান ও মেয়ে রজনী আক্তারকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ কমলাপুরের ১০৮ নং বাসার ছাদে গিয়ে গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। মারাত্মক অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় এলাকাবাসী তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় প্রথমেই মারা যায় শিশু আবু রায়হান। দুইদিনের ব্যবধানে কন্যা রজনীর শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিলাসী সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে জানান, তার স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের পর সেই স্ত্রীকে নিয়ে বনশ্রী থাকতে শুরু করেন। এ বিষয়টি তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই সন্তানদের নিয়ে পুড়ে মরার চেষ্টা করেন।

নিহত বিলাসীর পরিবার সূত্রে জানা যায়, রাজীব সিকিউরিটিজ অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স লিমিটেডের প্রধান সৈয়দ রাজীব আলী তার স্ত্রী বিলাসী ও দুই সন্তানকে নিয়ে দণি কমলাপুর এলাকার ১০৮ নম্বর বাসায় ভাড়া থাকেন। গত ১৮ জুন রাজীব তার ব্যবসায়ী পার্টনার আফরিন নামে এক তরুণীকে বিয়ে করেন। এ নিয়ে প্রথম স্ত্রী বিলাসীর সঙ্গে রাজীবের সম্পর্কের অবনতি হয়। প্রায়ই এ বিষয় নিয়ে উভয়ের বাকবিতণ্ডা হতে থাকে।

এই ঘটনায় অগ্নিদগ্ধ বিলাসীর স্বামী সৈয়দ রাজিব আলীকে তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ঘটনা ৩: সন্তানসহ পরপর দুটি আত্মহত্যার ঘটনা হয়তো উৎসাহী করে তুলেছিল রাজধানীর তেজকুনিপাড়া এলাকার গৃহবধূ মাকসুদাকে। সন্তানসহ বিলাসীর আত্মহত্যা চেষ্টার ঠিক একদিন পরেই রনানী রেলক্রসিং এলাকায় ঘটে এ ঘটনা।

স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মতি না দেয়ায় নিদারুণ অত্যাচার ভোগ করতে হয় হতভাগ্য মাকসুদাকে। মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করলেও সন্তানদের ভবিষ্যত নিয়ে তিনি অনিশ্চয়তায় পড়েন তিনি।

ফলে ৭ আগস্ট রাজধানীর বনানীর রেলক্রসিং এলাকায় মেয়ে তানজীনাকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেনের নীচে ঝাপিয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মাকসুদা। এ সময় ঘটনাস্থলেই মাকসুদা মারা যান। হাসপাতালে গুরুতর আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় তানজীনাকে।  

এ সময় ঘটনাটি অপলক চোখে তাকিয়ে দেখছিল মাকসুদার অবুঝ ছেলে শিশুসন্তান নাজমুল। হাসপাতালে আসার পর থেকেই নাজমুল সাংবাদিকদের তথ্য দিয়ে চলে। সে সময় কোনো জড়তা ছিল না তার চোখেমুখে। মায়ের ওপর বাবার অত্যাচারের পুরো বর্ণনাই সে দিয়েছিল সাংবাদিকদের।

এ ঘটনায় মাকসুদার ভাই ইউনুস আলী বাদী হয়ে ছয়জনকে আসামি করে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগে কমলাপুর জিআরপি থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় নিহতের স্বামী আশরাফ উদ্দীন, শ্বশুর আবদুল খালেক, শাশুড়ি আয়েশা আক্তার, ননদ মাজেদা ও লায়লা এবং দেবর কাশেম।

ঘটনা ৪: শুধুমাত্র আগস্ট মাসেই তৃতীয় বারের মত আত্মহত্যার ঘটনাটি ঘটে রাজধানীর পল্লবী এলাকায়। বিয়ের পাঁচ মাসের মাথায় স্বামীর যৌতুকের দাবি এবং সে দাবি পূরণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে স্বামীর অব্যাহত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেন সালমা নামে এক অন্তঃসত্ত্বা নারী।

সালমার পরিবার সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের মার্চ মাসে সালমা এবং তার স্বামী রাকিব হোসেনের বিয়ে হয়। পল্লবীর কালাপানির ১/২ নম্বর বাসায় থাকতেন তাঁরা।    

সালমার পরিবারের অভিযোগ ছিল, বিয়ের পর থেকেই রাকিব টাকার জন্য সালমাকে নানাভাবে চাপ দিচ্ছিলেন। এ জন্য সালমাকে ক্রমাগত মারধর, গালাগাল সহ্য করতে হয়েছে। একপর্যায়ে সালমাকে বাপের বাড়ি থেকে ৫০ হাজার টাকা এনে দিতে বলে রাকিব। তা না হলে সে সালমার গর্ভের সন্তানের পিতৃত্বের দায়িত্ব স্বীকার করবেন না বলেও হুমকি দেয়। এতে রাগে, ােভে, অভিমানে ২৭ আগস্ট শুক্রবার রাত ১২টার দিকে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন সালমা। মৃত্যুর সময় সালমা তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন বলে জানায় তার পরিবারের লোকজন।

এ ঘটনায় সালমার বাবা আবদুল জলিল বাদী হয়ে সালমার স্বামী রাকিব হোসেনকে আসামি করে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে পল্লবী থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। এর আগেই পুলিশ রাকিব হোসেনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে গ্রেপ্তার করে।

ঘটনা ৫: পারিবারিক কলহের জের ধরে ঘরের ছেলে সন্তানটি নিজের শরীরে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। ওই আগুন নেভাতে ঝাপিয়ে পড়ে মা, বাবা এবং পুত্রবধূ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়না। হাসপাতালের নেয়ার পর মাত্র ছয় ঘণ্টার ব্যবধানে মা এবং ছেলে পরপর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।

গত অক্টোবর মাসের ১৬ তারিখ রাজধানীর খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ান এলাকায় ৩১৬/৯ নং শান্তিপুরের নিজ বাসায় পারিবারিক কলহের এক পর্যায়ে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় আগুন নেভাতে গিয়ে জুয়েলের স্ত্রী গৃহিনী খুকু আক্তার মারাত্মকভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়। এছাড়া জুয়েলের পিতা আব্দুল হাইও আহত হন।

এ ঘটনার প্রথমদিকে বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল বলে জানানো হলেও মা এবং ছেলের পরপর মৃত্যুর পর বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা।

পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশের বাইরে থাকা জুয়েলের বড়বোন সুমী স্বামী সহ কয়েকদিন বাংলাদেশে বেড়াতে আসলে জুয়েলের কিছু টাকা পয়সা খরচ হয়। এ ব্যাপারে সে তার পিতার সাথে কথা বলতে গেলেই মূলত কলহের সূত্রপাত হয়। এক পর্যায়ে অভিমান করে জুয়েল ঘরের জেনারেটরের পেট্রোল দিয়ে এ ঘটনা ঘটায়।

এ সব আত্মহত্যাগুলো সারাদেশে চরম সমালোচনার সৃষ্টি করে। দেশের প্রগতিশীল সমাজ যেমন একদিকে দেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার প্রতি যেমন তীব্র ঘৃণা পোষণ করতে শুরু করে তেমনি সন্তানসহ মায়েদের আত্মহত্যার কারণে আত্মহত্যাকারী মাকে অনেকেই খুনি বলেও মন্তব্য করেন। তবে সমাজবিশেষজ্ঞরা এসব ঘটনা পর্যবেক্ষণে ঘটনার নেপথ্যে মূলত পুরুষদের ভূমিকাই প্রধান ছিল বলে মন্তব্য করেন।

বাংলাদেশ সময় : ১৩১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

জাতীয় এর সর্বশেষ