ঢাকা, মঙ্গলবার, ৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ব্রিটেনে আবার আসছে ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’! থার্টিফার্স্টে কড়া নজরদারিতে বাঙালি তরুণরা

সৈয়দ আনাস পাশা, লন্ডন করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০
ব্রিটেনে আবার আসছে ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’! থার্টিফার্স্টে কড়া নজরদারিতে বাঙালি তরুণরা

লন্ডন: ব্রিটেনের বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ স্থানে সন্ত্রাসী হামলা পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত সন্দেহে ৭ বাঙালি তরুণসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর নতুন করে আবার সন্ত্রা বিরোধী আইন ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’ পুনরুজ্জীবিত করার দাবি উঠেছে।

পুলিশের পক্ষ থেকে এই দাবি তোলা হয়েছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমগুলো জানাচ্ছে।



সন্ত্রাস দমনে নতুন আইন চালু হলে অন্য মুসলমান তরুণদের মত বাঙালি মুসলমানদের উপরও পুলিশি নজরদারি বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা বাঙালি কমিউনিটির।

থার্টিফার্স্ট নাইট সামনে রেখে এ কড়াকড়ি আরও আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, জনগণকে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা থেকে রায় ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’ আইনের মত একটি আইন খুবই প্রয়োজন। আর এ বিষয়টি সরকারকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন তারা।

এর আগে যে আইনটি ছিল চলতি বছরের প্রথম দিকে ইউরোপীয় আদালতের এক নির্দেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী টেরিজা মে তা বাতিল বলে ঘোষণা করেন। টেরোরিজম অ্যাক্ট ২০০০ এর ৪৪ অনুচ্ছেদের ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’ নামক এই আইনটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে, ইউরোপীয় আদালতের এমন মন্তব্যেই তা বাতিল হয়।

স্টপ অ্যান্ড সার্চ আইনটি নিয়ে ঐ সময় মানবাধিকার সংগঠনগুলোও সমালোচনামূখর ছিল। তাদের ভাষায়, এই আইনের কারণে ব্রিটেনে সংখ্যালঘুদের পুলিশি হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ‘স্টপ অ্যান্ড সার্চ’ এর মতো আইন প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে সরকারের সাথে আলোচনা চলছে।

তবে তাদের মতে, এই আইন ল্যহীনভাবে প্রয়োগ হবে না, সময় ও স্থান ভেদে ইউরোপীয়  আদালতের নির্দেশনা মেনেই প্রয়োগ করা হবে।

পুলিশের ঐ সূত্রটি আরও জানায় ইউরোপীয় আদালতের নির্দেশনার কারণে নতুন আইনে হয়তো আগের মত ইচ্ছেমাফিক মতা প্রয়োগের সুযোগ থাকবে না। তবে কিছু বাধ্যবাধকতা দিয়ে হলেও সন্ত্রাস   মোকাবেলায় ওইরকম একটি আইন এই মুহূর্তে খুবই জরুরি।
 
প্রস্তাবিত নতুন আইন প্রয়োগে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি থাকার বিধান থাকতে পারে, হতে পারে তা চিফ কনেস্টবল( পুলিশ-প্রধান) এমনকি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরই অনুমতি।

প্রাথমিক পরিকল্পনায় বলা হচ্ছে, এই আইন নিরাপত্তা দেবে উচ্চ পর্যায়ের কোন অনুষ্ঠান বা উৎসবের, যেমন আসন্ন অলিম্পিক গেমস। এই আইন প্রয়োগের সময়সীমা হতে পারে নির্দিষ্ট, হতে পারে এটি কোন নির্দিষ্ট সীমানার জন্যে, যে সীমানার মধ্যে সন্ত্রাসী আক্রমণের ঝুঁকি থাকে বেশি।

উল্লেখ্য, ব্রিটেনের টেরোরিজম আইনের ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী পুলিশ বর্তমানেও যে কাউকে তল্লাশি করতে পারে, যদি ঐ ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে যৌক্তিকভাবে সন্দেহজনক মনে হয়।

এদিকে, সন্ত্রাস দমনে নতুন আইন চালু হলে অন্যান্য মুসলমান তরুণদের মত বাঙালি মুসলমানদের উপরও পুলিশী নজরদারি বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞসহ বাঙালি কমিউনিটির নেতৃস্থানীয়রা।

গত সপ্তাহে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী-পরিকল্পনার সাথে জড়িত সন্দেহে অভিযুক্ত গ্র“পটির অধিকাংশ সদস্যই বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত হওয়ায় এই আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

নতুন করে স্টপ অ্যান্ড সার্চ আইন চালু করার পুলিশি দাবিও উঠেছে এই বাঙালি তরুণদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনার পর। অক্টোবর মাসে সাবেক ব্রিটিশ মন্ত্রী স্টিফেন টিমসকে ছুরিকাঘাত করার দায়ে বাঙালি তরুণী রোশানারা চৌধুরী দণ্ডিত হওয়ার পর থেকেই বাঙালি তরুণদের অনেকের প্রতি সন্দেহের দৃষ্টি পড়েছিল ব্রিটিশ সমাজের।

ইসলামি চরমপন্থার সাথে জড়িত থাকার বিষয়ে ব্রিটেনের মূলধারা এতদিন পাকিস্তান, ইয়েমেন, সোমলিয়া, আফগানিস্তান, ফিলিস্তিন, ইরাক, ইরান এসব দেশের তরুণদেরই সন্দেহের চোখে দেখতো। শুধু তাই নয়, এই নিয়ে এইসব দেশের সাথে ব্রিটেনের অনেকটা টানাপোড়নের সম্পর্কও চলছে। কিন্তু রোশনারা চৌধুরীর দণ্ড লাভ ও সর্বসাম্প্রতিক ৭ বাঙালি তরুণের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী পরিকল্পনার অভিযোগ উত্থাপিত হওয়ায় এই সন্দেহের তালিকায় এবার বাংলাদেশিদের নামও উঠেছে।

ব্রিটেনের মূল ধারার শীর্ষস্থানীয় জাতীয় দৈনিক ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় গত ক’দিন ধরে এই সন্ত্রাসী পরিকল্পনা ও এর সাথে বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত তরুণদের জড়িত থাকার খবর ফলাও করেই প্রচার হচ্ছে।

কোনো কোনো মিডিয়া গ্রেফতারকৃত সবাইকেই বাঙালি বলে খবর দিচ্ছে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭জন বাঙালি বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও বাকি দুইজন সম্পর্কে এখনও কিছু জানা যায়নি। ব্রিটেনের কোনো কোনেসা মিডিয়া এবং বাঙালি কমিউনিটিরও অনেকের ধারণা বাকি দুজনও বাঙালি।

ব্রিটিশ মিডিয়ায় ফলাও করে বিষয়টি প্রচার হওয়ায় বাঙালি পরিচালনাধীন রেস্টুরেন্টগুলোর মালিকরাও খদ্দেরদের বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন বলে জানা গেছে।

কার্ডিফ, স্টক-অন-ট্রেন্ট, বার্মিংহাম, লন্ডন, ম্যানচেস্টার, নিউক্যাসল ও লিড্সে বসবাসরত কয়েকজন বাঙালি ব্যাবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে এই উদ্বেগের কথা জানা যায়। তারা জানান, অনেক খদ্দের এইসব সন্ত্রাসীর সঙ্গে কমিউনিটির সম্পর্ক আছে কিনা, এমন প্রশ্নও করছেন রেস্টুরেন্ট মালিকদের। কার্ডিফ থেকে গ্রেফতার হওয়া আব্দুল মান্নানের নাম বদলের খবরও ব্যাপক আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে স্থানীয় কমিউনিটিতে।

বাংলানিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে আব্দুল মান্নান গুরুকান্ত দেশাই নাম ধারণের আগে ২০০৮ সালে আরো একবার ইসহাক ইলিয়াস নাম ধারণ করেছিল। তাঁর এই নাম বদলের উদ্দেশ্য কি এটি তদন্ত করছে পুলিশ।

আব্দুল মান্নান ওরফে গুরুকান্ত দেশাইসহ অভিযুক্ত বাঙালি তরুণরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কয়বার বাংলাদেশে গিয়েছে সেটিও তদন্ত করছে পুলিশ।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও  আফগানিস্তানের ইসলামিক চরমপন্থিদলগুলোর সঙ্গে এদের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু এগুলোও জানারও চেষ্টা চলেছে।

আল কায়েদা নেতা আনোয়ার আওলাকির অনুপ্রেরণা গ্রেফতারকৃত তরুণদের মত আর কত বাঙালি তরুণকে এই পথে নিয়ে আসছে এ বিষয়টি জানতেও বিভিন্নমূখী তৎপরতা চালাচ্ছে তারা।

বাঙালি পরিচালিত সন্দেহজনক বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসাও নজরদারিতে আনার পরিকল্পনা নিয়ে পুলিশ কাজ করছে বলে সূত্র জানায়।

আর এতসব তৎপরতার মধ্যে ব্রিটেনের বাঙালি অভিভাবকদের মধ্যে নতুন করে দেখা দিয়েছে আওলাকি আতঙ্ক। নিজেদের তরুণ সন্তানেরা কে কোথায় যাচ্ছে, কোনো মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হচ্ছে কি না, এইসব নিয়ে অভিভাবকরাও তরুণ সন্তানদের উপর শুরু করেছেন নজরদারি।

নতুন স্টপ অ্যান্ড সার্চ আইন চালু হওয়ার খবরে উদ্বেগও সৃষ্টি হয়েছে অনেক অভিভাবকের মধ্যে। এই আইনে অনেক নিরপরাধ তরুণও আবার হয়রানীর শিকার হবেন, এমনটিই আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ।

থার্টিফার্স্ট নাইট সেলিব্রেশনেও বাঙালি তরুণদের ওপর নজরদারির কড়াকড়ি বেশি থাকবে বলেও ধারণা করছেন তারা।

সব মিলিয়ে ব্রিটেনের বাঙালি তরুণরা হঠাৎই ব্রিটিশ জনগণের সন্দেহের ল্যবস্তু পরিণত হয়েছেন। আর এই সন্দেহ উচ্চ শিতি বাঙালী তরুণদের তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ চাকরি বাজারে আরো ঝূঁকিপূর্ণ অবস্থানে নিয়ে যাবে এমনটিই আশঙ্কা করছেন কমিউনিটি একটিভিস্টরা।

বাংলাদেশ সময় ১১০৩ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১০

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।